মুদাসসির নিয়াজ
‘অনাস্থা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল আস্থাহীনতা। স্বাধীনত্তোর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হয়েছে অনেকগুলো কেন্দ্র সরকার। সব মিলিয়ে বিভিন্ন সময়ে মোট ৩০ বার অনাস্থার ফাঁদে পড়েছে আমাদের দেশের সরকার। অনেক সময় সেই অনাস্থায় উতরে গেছে সরকার। আবার কয়েকবার পরাজয় স্বীকার করে পদত্যাগ করতে হয়েছে। সর্বশেষ অনাস্থা ভোটে হেরে মসনদ ছাড়তে হয় অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারকে। প্রথমবার ১৩ দিনের মাথায়, দ্বিতীয়বার ১৩ মাসের মাথায়। স্বাধীনোত্তর ভারতে ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে। আচার্য কৃপালিনী পণ্ডিত সেই প্রথম অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন নেহরু সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ২৯ বার অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। আর এবার নিয়ে ৩০ বার হল অনাস্থায় ভোটাভুটি।
১৯৬৩ থেকে ২০২৩ – বিগত ৬০ বছরে একে একে ৮ জন প্রধানমন্ত্রী পড়েছেন অনাস্থার গেরোয়। যে বা যারা জয়ী হয়ে ক্ষমতায় থেকে গিয়েছেন তাদের কাছে এই প্রস্তাব গলায় গেরো বা ফাঁস না হয়ে কপালে ফোঁটায় পরিণত হয়েছে। পূর্বসূরিদের সেই পরম্পরায় নবতম সংযোজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকার। এই নিয়ে দু-দুবার অনাস্থার ফাঁদে পড়তে হল মোদি সরকারকে।
আসাম থেকে নির্বাচিত লোসকভার কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ মঙ্গলবার ৮ আগস্ট অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। সেই প্রস্তাব পাস হলে আজ ১০ আগস্ট পর্যন্ত চলে অনাস্থা বিতর্ক। মোদি সরকার প্রথমবার অনাস্থার কবলে পড়েন ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই। সেবার মোদি অনাস্থা প্রস্তাবেবর পক্ষে কম ভোট পড়ে। ফলে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় থেকে যায় মোদি সরকার।
এবার কংগ্রেস তথা ২৬টা বিরোধী দলের মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’ এবং তেলেঙ্গানার বিআরএস দল আলাদাভাবে মোদির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে। এবার মোদি সরকারের ৯ বছরের মাথায় দ্বিতীয় মেয়াদের প্রায় শেষ লগ্নে এল অনাস্থা। বিরোধীরা জানান, তাদের উদ্দেশ্য সরকার পতন নয়। লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীর রঞ্জন চেীধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মণিপুর ইস্যুতে সংসদে আলোচনা করছে না, তিন মাস কেটে গেলেও মণিপুর নিয়ে কোনও কথাও বলছেন না। তাই তাকে মুখ খুলতে বাধ্য করতে এই অনাস্থা। যাতে নিয়ম অনুযায়ী শেষদিনে জবাবী ভাষণ দিতে বাধ্য প্রধানমন্ত্রী। তাই অনাস্থা প্রস্তাব জেতার থেকেও বড় কথা হল মোদির মুখ খোলানো। তাই বিরোধীরা এই অনাস্থাকে নৈতিক জয় বলে দাবি করছে।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকে এই নিয়ে কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে লোকসভায় মোট ২৮ বার অনাস্থা প্রস্তাব আনা হল। অনাস্থা প্রস্তাবের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, শীর্ষে রয়েছেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দীর্ঘ ১৬ বছরের মেয়াদে তাঁকে ও তাঁর সরকারকে ১৫বার অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ১২দফা এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত ৩ দফা অনাস্থা প্রস্তাবের সম্মুখীন হন তিনি। এর পরেই রয়েছেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পিভি নরসিমা রাও। এরা তাঁদের কার্যকালের মেয়াদে ৩দফা করে অনাস্থার মুখে পড়েন। মোরারজি দেশাই দুবার এবং অটল বিহারি বাজপেয়ীর বিরুদ্ধে একবার অনাস্থা আনে বিরোধীরা।
জওহরলাল নেহরু এবং রাজীব গান্ধী মাত্র একবার করে অনাস্থার মুখে পড়েন। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিং, ভি.পি সিং, চন্দ্রশেখর, এইচ.ডি দেবগৌড়া এবং আই.কে গুজরাল কখনো অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হননি। অনাস্থা প্রস্তাব মাঝে মাঝে সরকারের জন্য হুমকিও হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এর মাধ্যমে সরকার পতনের সম্ভাবনাও থাকে। ষষ্ঠ লোকসভা প্রথমবারের মতো একটি অ-কংগ্রেস দলকে ক্ষমতায় এনেছিল। যখন মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
তবুও তিনি দুবার অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হন। প্রথমটিতে তিনি জয়ী হলেও দ্বিতীয়দফার আলোচনা অমীমাংসিত থেকে যায়। ১৯৭৯ সালের ১১ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন ওয়াই.বি চ্যবন। সেই বিতর্ককে অবান্তর আখ্যা দিয়েও প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মোরারজি দেশাই। একইসঙ্গে রাজনীতি থেকে চিরতরে অবসরও নেন।
অনাস্থা প্রস্তাব হল লোকসভায় সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের পেশ করা প্রস্তাব। এই প্রস্তাব, সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মে পার্লামেন্টের কার্য পরিচালনা সংক্রান্ত বিধির ১৯৮ নং ধারায় আনা হয়। প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হল সরকার হাউজের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থা অর্জন করতে পারে কিনা, তারই একটা পরীক্ষা। অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর উভয় পক্ষের আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর ভোটাভুটি হয়। সেই ভোটের ফলাফলেই সরকার থাকবে কি-না তা স্থির হয়। অনাস্থা ভোটে হেরে গেলে সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়।
মোদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল তেলেঙ্গানা ইস্যুতে ওই নবগঠিত রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা নিয়ে। সেবার ৩২৫-১২৬ ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল অনাস্থা প্রস্তাব। সেবারও মোদি সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। এবারও বিজেপি নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদীর এনডিএ সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। এবার টিম মোদির ঝুলিতে রয়েছে ৩২৩ আসন। বিরোধীদের রয়েছে প্রায় ১৫০। আর কোন পক্ষেই নেই এমনন নিরপেক্ষ সাংসদ রয়েছেন ৭০ এর মতো। এখন পর্যন্ত সবথেকে বেশিবার অনাস্থার মুখোমুখি হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর আমলে ১৫ বার অনাস্থা এনেছেন বিরোধীরা। অর্থাৎ দেশে এ পর্যন্ত যতবার অনাস্থা এসেছে, তার অর্ধেকবার এসেছে ইন্দিরার বিরুদ্ধে। কিন্তু একবারও তাঁকে টলাতে পারেনি। তিনি প্রতিবার আস্থা অর্জনে সফল হয়েছেন।
আবার ১৩ দিন বা ১৩ মাসের সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারেননি অটলবিহারী বাজপেয়ি। কিন্তু অর্জন করেছিলেন আস্থা। মানুষের। তাই ১৯৯৯ সালে ভোটে জিতে এসেছিলেন ক্ষমতায়। রাজনীতির সফরের দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বুঝেছিলেন, নিজের কাজ করে যেতে হবে। তাহলেই মিলবে দেশের মানুষের আশীর্বাদ। মুখে দেশসেবার বুলি ফোটালে হবে না, করে দেখাতে হবে কাজে। তাই আজও সংসদের অলিন্দে ভেসে বেড়ায় তাঁর সেই বক্তৃতা…‘ক্ষমতার খেলা চলবে। সরকার আসবে… যাবে। দল গঠন হবে, ভেঙেও যাবে। কিন্তু এই দেশ যেন থাকে। দেশের গণতন্ত্র যেন মাথা উঁচু করে সর্বদা অস্তিত্ব জাহির করতে পারে।’ মোদি কিন্তু এমন নরম সুরে কথা বলতে অভ্যস্ত নন। অনাস্থা বিতর্ক তিনদিন ধরে চললেও পার্লামেন্টে একটিবারের জন্যও তাঁর টিকি দেখা যায়নি। এই তিনদিন তিনি ভাষণ মকশো করছিলেন, হোম ওয়ার্ক করছিলেন। যাতে বৃহস্পতিবার জবাবী ভাষণ দিতে গিয়ে চোখা চোখা শব্দ ও বাক্যবন্ধনী তিনি বিরোধীদের ছুড়ে মারতে পারেন। আদ্যোপান্ত বললেন সেভাবেই।
আজ সংখ্যার জোরে অনাস্থা প্রস্তাব হেরে গেল নরেন্দ্র মোদির সরকারের কাছে। কিন্তু যে কারণে এই অনাস্থা আনা হয়েছিল, সেই মণিপুরের আগুন কি নিভবে? মাস তিনেক আগে যে দুই মহিলাকে গণধর্ষণের পর সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে প্রকাশ্য রাস্তায় ঘোরানো হয়েছিল, তাদের কি হবে? তাদের সতীত্ব কি ফেরানো যাবে? তাদের ক্ষতিপূরণ কী হবে? কে দেবে? অগ্নিগর্ভ মণিপুর থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে হরিয়ানায় যে একতরফা দাঙ্গা লাগানো হয়েছে, তার কী হবে? শুধু দাঙ্গা করে মুসলিমদের ঘরবাড়ি, দোকানপাঠ, মসজিদ, মাদ্রাসা, রওজায় তাণ্ডব চালিয়ে ইমামকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। তাদের অপূর্ণ বাসনা পূরণ করতে সেখানকার ডাবল ইঞ্জিন সরকার দাঙ্গার পর বেছে বেছে মুসিলমদের ধরপাকড় চালাচ্ছে এবং তাতেও তৃপ্ত না হয়ে বুলডোজার দিয়ে মুসলিমদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। অনাস্থা প্রস্তাবকে হারিয়ে মোদি সরকার ক্ষমতায় বহাল তবিয়তে থাকলেও মণিপুর, হরিয়ানার কী হবে? সংখ্যালঘুদের ওপর এই সরকারের অনাস্থাই কি জারি থাকবে?