ফিলিপ শায়খ:
হামাস একাধিক কারণে এমন বড় হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই আনুমান বিশ্লেষকদের। এর মধ্যে আছে আঞ্চলিক রাজনীতিতে পরিবর্তন। কয়েক বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্কের উন্নতি হামাসের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা ও হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমেরিকা কার্যত ফিলিস্তিনিদের পাশ কাটিয়ে কিংবা বলা যেতে পারে ফিলিস্তিন ইস্যুকে বাদ দিয়ে এই অঞ্চলে যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কূটনীতি শুরু করেছিল, তা হামাসের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে বলে মনে হয় না। বিল ক্লিন্টনের আমলে ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির আওতায় পশ্চিম তীরে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন যে ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র’, তা এখন আর ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন দেখায় না।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও হামাসের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে থাকবে। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বছরের বেশি সময় ধরে সংকটে রয়েছেন। তাঁর প্রতি দেশবাসীর সমর্থন কমছিল এবং তিনি বিভিন্ন আইনি সমস্যার মোকাবিলা করছিলেন। পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে খর্ব করার মতো ইস্যুতে দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ও বিরোধিতার মুখে পড়ে নাজেহাল অবস্থায় নেতানিয়াহু নিজেকে রক্ষায় ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরও উগ্রবাদী ও চরমপন্থী নীতি গ্রহণ করছিলেন। এতে তিনি আরও কট্টরপন্থী দলগুলোর সমর্থন পেয়েছেন। হামাস বুঝে গেছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ইসরায়েলের ক্ষমতায় যাঁরা আসবেন, তাঁরা আরও বেশি যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠবেন। হামাস নেতৃত্বের এই ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করা যায়। নেতানিয়াহু যেভাবে বিপদগ্রস্ত হচ্ছিলেন, এই হামলা তাঁকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করবে। ইতিমধ্যেই তাঁর জোট সরকারের পাশে থেকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে সাবেক সেনাপ্রধান বেনি গান্টজ এর দল ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট পার্টি। অর্থাৎ নেতানিয়াহুর জোড়াতাপ্পি সরকার এখন অনেকটাই মজবুত।
কেউ কেউ বলছেন, এই যুদ্ধ শুধুমাত্র ইজরায়েল ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। এমনকী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা ক্রুসেডের আশঙ্কা করছেন অনেকে। তার একটা ইঙ্গিত হল, শিয়া প্রদান ইরান এবং হিজবুল্লাহকে এই যুদ্ধে পাশে পেয়েছে সুন্নি প্রধান হামাস। এটা মুসলিম বিশ্বের মধ্যে শিয়া, সুন্নি বিভাজন কিছুটা কমতে পারে। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি জন্মাতে পারে। তাছাড়া সম্প্রতি বিশ্বের সুন্নি পাওয়ার হাউস সৌদি আরবের সঙ্গে শিয়া পাওয়ার হাউজ ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। তারপরই সিরিয়ার শিয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আরব লীগের সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। আবার ইজরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে যে চর্চা বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে, সেই জায়গা থেকে আপাতত হলেও সরে এসে প্রক্রিয়াটি স্থগিত করেছে সৌদি সরকার। এই মর্মে সৌদি সরকারের কোনও এক মহল থেকে বলা হচ্ছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে এ ব্যাপারে শর্ত হিসেবে আরোপ করেছে তারা।
তবে অন্যদিকটাও ভাবতে হবে। আমেরিকা পুরোদমে ইজরায়েলের পক্ষে থাকলেও সামরিক সাহায্য দিচ্ছে। বিপরীত দিকে রয়েছে দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গাজা বা হামাসকে সেভাবে সাহায্য করতে পারবে না রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধে ঢিল দিলে পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একযোগে কোমর বেঁধে লাগতে পারে। সেদিকটাও ভাবতে হচ্ছে রাশিয়া বা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে। চীন একা এশিয়া থেকে সাত সাগর তের নদী পার হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে হামাসকে সেভাবে সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয় না। রইল বাকি ইরান। এই দেশটি প্রযুক্তি ও সমরবিদ্যায় উন্নত হলেও ইরানকে সর্বদাই আমেরিকা-ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হয়। এটা তাদের অস্তিত্বের কারণ। একটু ঢিল পেলেই ইরানের হামলা করতে পারে মার্কিন ও ইজরায়েলি বাহিনী। তাই ইরানকে দিনরাত যুদ্ধের মহড়া দিতে হয়।
এমতাবস্থায় ইরান কতখানি হামাসকে সহযোগিতা করতে পারবে, সেটা বড়সড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান একজোট হলেও আমেরিকা, ইজরায়েলের মোকাবিলা করা কখনাই সম্ভবপর নয়। তবে একটা প্লাসপয়েন্ট হল, বিশ্বজুড়ে ইজরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলছে। হামাসের বিরুদ্ধে কোনও দেশে এমনটা হয়নি। বরং সব দেশের সুশীল সমাজ, গণতন্ত্রকামী ও শান্তিকামী লোকজন গাজা তথা ফিলিস্তিনের ব্যাপারে সংহতি জানাচ্ছে। সুতরাং যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক মহলে নিঃসন্দেহে চাপেই আছেন। তাই একেবারে বেপরোয়া হয়ে গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস বা দখল করে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায় হবে হামাসের হাতে বন্দি থাকা প্রায় দুশো ইহুদি। হামাসের দাবি, ইজরায়েলের বিভিন্ন জেলে বন্দি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিতে হবে। এটাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে।
সর্বশেষ কথা হল ইজরায়েল বিভিন্ন সময় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সামরিক হামলা করে চলেছে বা করে থাকে। সেই তালিকায় রয়েছে সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন প্রভৃতি দেশ। হামাস কিন্তু কোনওকালেই এমনটা করেনি। তারা কেবল নিজেদের স্বাধীনতা, ইজরায়েলি আগ্রাসন ও দখলদারির অবসান চায়। এটাও বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করছে।