তিনদিন পর বাংলাদেশে নির্বাচন, জেলে ২০ হাজার বিরোধী নেতা, ডামি প্রার্থীর ছড়াছড়ি, সাজানো ভোট বয়কটে বিরোধী দল

ডেভিড বার্গম্যান

আর মাত্র তিনদিন পর ৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। তবে একে নির্বাচন না বলে প্রহসন বা নাটক বলছে বিরোধী দলগুলো। তাদের মতে, এই নির্বাচনে দেখানো হবে যে, বাংলাদেশের মানুষের আসলে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে এবং দিন শেষে তারা আওয়ামী লীগকেই সরকার গঠনের জন্য ভোট দিয়েছে এবং তারই ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনা পরপর চতুর্বার সরকার গঠন করছে।

এরইমধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে দেশের মধ্য ও বাইরে থেকে বেশ কিছু খারাপ ‘রিভিউ’ পাওয়া গেছে। এটি যদি কোনো সিনেমা হত, তাহলে মুক্তির আগেই এটিকে বক্স অফিস থেকে সরিয়ে নেয়া হত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। এই নাটকের পরিচালক তার চাকরি ধরে রাখতে চান। যারা এই নাটকে বিনিয়োগ করেছেন তারাও আশাবাদী যে দ্রুতই তাদের লাভ ও লগ্নি সুদে আসলে উঠে আসবে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ম বাতিল করে দিয়েছে দলটি। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশে যে দুটি নির্বাচন হয় তাকে ‘অত্যন্ত সন্দেহপূর্ণ’ বলা যায়। ২০১৪ সালে বিরোধী দলগুলি বিএনপি’র নেতৃত্বে নির্বাচন বয়কট করেছিল। এবারও সেই একই অবস্থা। অর্থাৎ এবারও একতরফা ভোট হতে চলেছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু ওই বছর নির্বাচনে পদ্ধতিগতভাবে কারচুপি হয়েছিল, যা ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় বিরোধীদের ভয়কেই সঠিক প্রমাণ করে। তাহলে এবার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কী করবে? হয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের কারচুপির কাছে হেরে যাবে কিংবা এতে নির্বাচন বয়কট করায় এমনিতেই হেরে যাবে। জয়ের কোনো সম্ভাবনাই যখন নেই, তখন বিএনপি ২০১৪ সালের সেই কৌশলকেই আবার গ্রহণ করেছে। তাদের আশা ছিল, সরকার হয়ত কিছুটা নরম হবে এবং এমন সব পরিবর্তন আনবে যা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে।

দীর্ঘদিন ধরেই আমার ধারণা ছিল যে, বিরোধী দলগুলো আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগ সরকারের স্বার্থই রক্ষা হয়েছে। এর কারণ এই নয় যে, সরকার ভয় পেয়েছিল যে বিএনপি নির্বাচন করলে তাতে জিতে যাবে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আওয়ামী লীগ কখনই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে জিততে দিত না। কিন্তু যখন বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয় না, তখন সরকারকে অনেক কম সমালোচনার শিকার হতে হয়। আবার তাদেরকে কারচুপি করে জেতার মতো কঠিন ঝামেলার মধ্য দিয়েও যেতে হয় না।

তাই সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিএনপি তাদের দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন করলেও সরকারের জন্য সেগুলো মেনে নেয়ার কোনো কারণ ছিল না। গত কয়েক সপ্তাহে পুলিশ প্রায় ২০ হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে। সমালোচকরা দাবি করতেই পারেন যে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন নিশ্চিত করতেই এই গণগ্রেপ্তার চালানো হয়েছে।

নির্বাচনে যেহেতু কোনো বিরোধি দল নেই, তাই সরকারকে কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ‘চেহারা’ তৈরি করতে হবে। এটা অবশ্যই করা কঠিন যখন কোনো বিরোধী দল অংশ নিচ্ছে না। যাহোক আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সালে যা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি না করতে খুব আগ্রহী। ওই বছর ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫০ টিরও বেশি আসনে আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়েছিল। ফলে নির্বাচনের আগেই জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এবার তাই দল থেকে মনোনয়ন দেয়া প্রার্থীর সঙ্গে নিজ দলের অন্য নেতাদেরও ‘ডামি’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহিত করেছে আওয়ামী লীগ।

দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগকে একটি বিরোধী দলও সাজাতে হবে। এই ভূমিকা নেয়ার জন্য তার মিত্র দল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হয়। কিন্তু নির্বাচনে কীভাবে জাতীয় পার্টির কিছু আসনে জয় নিশ্চিত করবে আওয়ামী লীগ? এ জন্য আওয়ামী লীগ ২৬ আসন থেকে নিজেদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়। যাতে ওইসব আসনে ‘বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টি হেলায় জিততে পারে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের নাগরিকরা এই নির্বাচনকে বৈধ বলে মেনে নিয়েছে – এমন ধারণা দেয়ার জন্য আওয়ামীলীগ চায় এবার যাতে অপেক্ষাকৃত বেশি ভোট পড়ে। ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কট করেছিল তখন ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ২০১৪ সালে বিএনপি বয়কট করলে ভোট পড়েছিল ৩৯ শতাংশ। আওয়ামী লীগ অন্তত ২০১৪ সালের কাছাকাছি ভোট দেখতে চায়।

দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের একটি উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী ভিত্তি রয়েছে, তবে সেটা কতটা বড় তা খুবই অস্পষ্ট, দলটি নিজেও নিশ্চিত নয়। এছাড়াও, আওয়ামী লীগ জানে যে নির্বাচনে যেখানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থকও ভোট দিতে যাবে না।  নিঃসন্দেহে, শাসক দল চাইলেই ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে একটি সন্তোষজনক সংখ্যক ভোট পরার কথা ঘোষণা করতে পারে। এটি করাও অনেক সহজ। কারণ ভোটে কোনো বিরোধী কর্মী বা পর্যবেক্ষক থাকবে না, যারা কোনো অভিযোগ তুলবে। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগ চায় ভোটকেন্দ্রে মানুষের ভোট দেয়ার দীর্ঘ সারি থাকুক। বিশ্বকে তারা বলতে চায়, আপনারা দেখুন, লাইনে দাঁড়িয়ে এত লোক ভোট দিতে এসেছে। অর্থাৎ এই ভোট জনগণের ভোট।

আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যেই এই নির্বাচন বেশ বিব্রতকর। কিন্তু দলটি যতক্ষণ তারা ক্ষমতায় আছে তারা এগুলো কিছুই গায়ে মাখছে না। নতুন সরকার সহজেই পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বের সমালোচনা সহ্য করে নেবে। তার উপর আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে (চীন ও রাশিয়ারও রয়েছে)। ভারত বেশ প্রকাশ্যেই এই নির্বাচনরূপী প্রহসন বা নাটকের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছে। শিগগিরই সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর এটি হবে সেক্যুলার কর্তৃত্ববাদের আরেক বিজয়।

( Scroll.in-এ প্রকাশিত ডেভিড বার্গম্যানের লেখা থেকে অনূদিত)

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: