মীযান ডেস্ক: ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ এক ধর্মীয় নেতা। ২০২১ সালে ড. হাসান রুহানির পর এই সাবেক বিচার বিভাগীয় প্রধান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপকভাবে জয়ী হন। রাইসি এমন এক সময় রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেন, যখন ইরান তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা, ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনা-সহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। ড. রাইসি দায়িত্ব গ্রহণের পর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইরান, যার মধ্যে ২০২২ সালে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সরকারবিরোধী প্রবল বিক্ষোভ, গাজায় ইসরায়েল ও ইরান সমর্থিত স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ। অন্যদিকে, ১৯৮০-র দশকে রাজনৈতিক বন্দিদের গণমৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাইসির ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। তবে তার কর্মজীবন বেশ ঘটনাবহুল। বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। খুব অল্প বয়সে সাফল্য পান তিনি। ঐতিহাসিক ইসলামী বিপ্লবের পর রাইসি যোগ দেন বিচার বিভাগে। বেশ কয়েকটি শহরে কৌঁসুলির দায়িত্ব পালন করেন। আয়াতোল্লা খামেনি ১৯৮১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আর মাত্র ২৫ বছর বয়সে মি. রাইসি তেহরানের ডেপুটি কৌঁসুলি নিযুক্ত হন। এক পর্যায়ে দেশের শীর্ষ বিচারপতি নিযুক্ত হন রাইসি। বিচার বিভাগে তাঁর দীর্ঘ চার দশকের অভিজ্ঞতা ছিল। ব্যক্তিগত জীবন: ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্ম ইব্রাহিম রাইসির। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে এতিম হন। তাঁর বাবাও ধর্মগুরু ছিলেন। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সে কুম শহরে এক মাদ্রাসায় যোগ দেন রাইসি। আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শহীদ মোতাহারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্র এবং আইনের মৌলিক বিষয়ে পিএইচডি করেন। সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি পশ্চিমা সমর্থিত শাহ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ রাজবংশের শাসনের পতন ঘটে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাকে সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলনে দেখা যেতে থাকে। পশ্চিমা সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর বিচার বিভাগে যোগ দেন ইব্রাহিম রাইসি। আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছে প্রশিক্ষণের সময় বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক আদালতে প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন ইসলামী বিপ্লবের পুরোধা আয়াতুল্লাহ খামেনি। রাইসির স্ত্রী জামিলে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, তাদের দুই সন্তান আছে। রাইসির শ্বশুর আয়াতুল্লাহ আহমাদ আলামোলহোদাও একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা, যিনি মাশহাদ শহরে জুম্মার নামাযে ইমামতি করেন। রাষ্ট্রীয় পরিদর্শক সংস্থার প্রধান: রাষ্ট্রীয় পরিদর্শক সংস্থার প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন রাইসি। ইরানের বিচার বিভাগের প্রথম উপ-প্রধান পদে নিযুক্ত হন এবং ২০১৪ সালে ইরানের মহাকৌঁসুলি (প্রসিকিউটার জেনারেল) পদের দায়িত্ব পান। দু-বছর পর আয়াতুল্লাহ খামেনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি বা রাষ্ট্রীয় পরিদর্শক সংস্থার দেখভালের গুরুদায়িত্ব তুলে দেন রাইসির হাতে। এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মাশহাদে অষ্টম শিয়া ইমাম রেজার দরগার রক্ষণাবেক্ষণ বা তত্ত্বাবধান করে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের দাতব্য এবং অন্যান্য সেবামূলক সংস্থা পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের হাতে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: ২০১৭ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়ে পর্যবেক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন রাইসি। ওই নির্বাচনে অবশ্য তিনি জেতেননি। জিতেছিলেন ড. হাসান রুহানি। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরাজয় তার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারেনি। ২০১৯ সালে আয়াতুল্লা খামেনি রাইসিকে দেশের বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করেন। তার পরের সপ্তাহেই তিনি অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস বা বিশেষজ্ঞমণ্ডলির ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দেশটির পরবর্তী সবোর্চ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে ৮৮ জন ধর্মীয় নেতার সমন্বয়ে গঠিত এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পরিষদ। উল্লেখ্য, বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাইসির কার্যকালে বিচার ব্যবস্থায় বেশকিছু সংস্কার হয়। ফলে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা কমে। যদিও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে চীনের পরেই রয়েছে ইরান। আমেরিকা, ইসরাইল তথা পশ্চিমা বিশ্ব এ নিয়ে বরাবর ইরানের সমালোচনা করলে, তেহরান প্রশাসন জবাবে বলে, তাদের দেশে পশ্চিমাদের মতো নিত্যদিন বন্দুকবাজ হামলা, খুনোখুনি, গোলাগুলি ইত্যাদিতে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হয় না। পশ্চিমা বিশ্বের মতো অকাতরে আত্মহত্যা হয় না বা স্বেচ্ছামূত্যু হয় না ইরানে। আঞ্চলিক উত্তেজনা: কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সাত বছর পর ২০২৩ সালের মার্চে রাইসি সরকার ইরানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী সুন্নি শক্তি সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতায় রাজি হয়। কিন্তু তার কয়েক মাস পরেই ৭ অক্টোবর হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে অতর্কিতে রকেট হামলা চালালে আঞ্চলিক উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। সেই থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ ৮ মাস ধরে লাগাতার ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এই উত্তেজনা বৃদ্ধি একটি অঞ্চলিক যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে এমন আশঙ্কা এপ্রিলে আরও জোরদার হয়, যখন ইরান প্রথমবার সরাসরি সামরিক হামলা চালায় ইসরায়েলে। সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে প্রাণঘাতী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইলে ৩০০-রও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েল এর জবাবে ইরানের এক বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ মে রবিবার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বাঁধ উদ্বোধনের সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইরানের সমর্থনের ওপর জোর দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেন, 'ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের প্রথম ইস্যু'। সেই উদ্বোধন করে ফেরার পথেই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হন প্রেসিডেন্ট রাইসি ও ইরানের বিদেশমন্ত্রী সহ মোট ৮জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।