সওয়াল জওয়াব: বেনামাযীর ব্যাপারে শরীয়তের বিধান

প্রশ্ন: একজন লোক নিজেকে মুসলমান দাবি করে, কিন্তু সে নামাযও আদায় করে না, রোযাও রাখে না। তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? মৃত্যুর পর তার জানাযার নামায আদায় করা যাবে?

উত্তর: আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। এমন লোক সম্পর্কে আপনার মতামত কী, যাকে সরকার বা কোনো কোম্পানী চাকুরী দিয়েছে, সেই চাকুরীতে সে বেতনও পাচ্ছে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে তাকে জবাবদিহিও করতে হয়, কিন্তু সেই ব্যক্তি নিজের কর্তব্য পালনে গাফিলতি করে। সুস্থ সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ডিউটিতে অনুপস্থিত থাকে। কোম্পানীর শীর্ষকর্তার সামনে বিষয়টি তুলে ধরা হলে তিনি নিশ্চিত বলবেন, তাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হোক। কিছু লোক বলবে জরিমানা অথবা অন্য কোনো শাস্তি দেওয়া হোক। তাদের এ রকম শাস্তি নির্ধারণ করা বৈধ হবে।

বেনামাযীর সাথে ইসলামের ভূমিকাও একই রকম। কোনো কোনো আলেম বলেছেন, নামায আদায় করা যেহেতু মুসলমানদের সর্বপ্রথম কর্তব্য, কাজেই বেনামাযী ব্যক্তি অবশ্যই ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে। আলেমদের একাংশের মতে, শুধু নামায আদায় না করলেই কাফের ফতোয়া দেওয়া যাবে না, তবে যে বেনামাযী নামাযের ফরয হওয়াকে অস্বীকার করে, নামায ফরয হওয়া সম্পর্কে ঠাট্টা-তামাশা করে, সে অবশ্যই ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। কিন্তু যদি নামায ফরয হওয়ার কথা স্বীকার করেও অলসতা বা গাফিলতি করে নামায আদায় না করে, তবে সে ইসলাম থেকে খারিজ হবে না। যারা নামায নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে বলেন, ”যখন তোমরা (মানুষদের) নামাযের জন্য ডাকো, তখন এই আহ্বানকে এরা হাসি-তামাশা ও খেলার বস্তু বানিয়ে নেয়। এরা হচ্ছে এমন এক সম্প্রদায়, যারা (হক-বাতিলের) কিছুই বোঝে না” (সূরা আল মায়েদা: ৫৮)।

এই আয়াতে সেসব লোক সম্পর্কে ধারণা করা যায়, যারা নামায, রোযা এবং অন্যান্য ইবাদাতকে পশ্চাৎপদতা এবং সেকেলে কাজ বলে মনে করে। আর যারা আল্লাহর ইবাদাত করে, তাদেরকে ঠাট্টা-তামাশা করে। এ কারণেই সকল আলেম এবং ফকীহর মতে, যারা নামায এবং অন্যান্য ইসলামী বিধান সম্পর্কে উপহাস-ঠাট্টা করে, বুঝতে হবে তারা ইসলামের সীমানা থেকে বের হয়ে গেছে। নিম্নোক্ত হাদীসে এ কথার সমর্থন রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, একজন মানুষের সঙ্গে কুফরীর পার্থক্য হচ্ছে নামায।’

যে ব্যক্তি অলসতা কিংবা কর্মব্যস্ততার কারণে নামায আদায় করে না, তবে এটা যে তার অন্যায় ও পাপ তা স্বীকার করে, তার সম্পর্কে ফকীহদের অভিমত হল: (১) হানাফী মাযহাব অনুযায়ী তাকে ফাসেক মনে করতে হবে। নামায শুরু না করা পর্যন্ত তাকে প্রহার করা যাবে।

(২) ইমাম মালেক এবং ইমাম শাফেয়ীর মতে, সেই ব্যক্তি ফাসেক এবং কাফের। তবে সে যদি নামায ত্যাগে অবিচল থাকে, তাহলে তাকে গ্রেফতার বা প্রহার করাই যথেষ্ট নয়; বরং তাকে হত্যা করতে হবে।
(৩) ইমাম আহমদের মতে, সেই ব্যক্তিকে মুরতাদ মনে করতে হবে, তার কাছে তাওবাহ করার দাবি জানাতে হবে। যদি তাওবাহ না করে তবে তার শিরচ্ছেদ করতে হবে। কুরআন-হাদীসের বর্ণনা ইমাম আহমদের অভিমতকেই জোরালোভাবে সমর্থন করে। আমার মতে, এই অভিমতই যুক্তিগ্রাহ্য। এ প্রসংগে কুরআন ও হাদীসের যুক্তি পেশ করা যাচ্ছে।
(ক) নামায আদায় না করাকে কুরআনে কাফেরদের অভ্যাস বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ”এই যালেমদের অবস্থা হচ্ছে, এদেরকে যখন বলা হয়, তোমরা আল্লাহর দরবারে নত হও, তখন তারা নত হয় না” (সূরা আল মোরসালাত: ৪৮)।
আল্লাহ আরো বলেন, ”তবে এরা যদি তাওবাহ করে (দ্বীনের পথে ফিরে আসে) এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তোমরা তাদের পথ ছেড়ে দাও, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও বড় দয়াময়” (সূরা আত তাওবা: ৫)।
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, শুধু শিরক থেকে তাওবাহ করলেই জিহাদ বন্ধ করা যাবে না; বরং নামায আদায় না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। সূরা মুদ্দাসসিরে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ”জান্নাতীরা দোযখীদের জিজ্ঞাসা করবে, কী আমলের কারণে তোমরা দোযখে প্রবেশ করেছ? তারা জবাবে বলবে, আমার তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না, যারা নামায আদায় করে।”
(খ) রাসূল (সা.) বলেন, বান্দা এবং কুফুরীর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামায আদায় না করা। অন্য হাদীসে রয়েছে, আমাদের এবং তাদের মধ্যে নামাযের চুক্তি রয়েছে, যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করেছে, সে কুফুরী করেছে। (বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ)।
এক ওয়াক্ত নামায আদায় না করলে নেক আমল নষ্ট হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সেই ব্যক্তির কি রকমের শাস্তি হবে? যে ব্যক্তি সকল নামাযই ত্যাগ করেছে। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, যারা জামাতে নামায আদায় করে না, রাসূল (সা.) তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যে ব্যক্তি মোটেই নামায আদায় করে না, তার শাস্তি তো আরো ভয়ানক।
সাহাবায়ে কেরামও নামায ত্যাগ করাকে কুফরী মনে করতেন। হযরত আলী (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি নামায পড়ে না, সে কাফের। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যে নামায ছেড়ে দিয়েছে, সে কাফের হয়ে গেছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) এবং হযরত আবুদারদা (রা.) থেকেও এ রকম বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে। এই সকল দলীল থেকে প্রমাণ হয়, যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করবে সে কাফের। কাফের না বলা গেলেও সে যে ফাসেক – এ বিষয়ে সর্বসম্মত মতামত রয়েছে। কাজেই যারা নামায আদায় করে না, তাদের উচিত আত্মসমালোচনা করা, তাওবাহ করা এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসা।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, বেনামাযীকে সালাম দেওয়া উচিত নয়, তার সালামের জবাবও দেওয়া উচিত নয়। তার কাছে নিজের মেয়ে বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কারণ, প্রকৃতপক্ষে সে মুসলমানই নয়। শরীয়তে কোনো অবস্থায় নামায মাফ হবে না। যতরকম ওযরই থাক না কেন। পানি যদি না থাকে, তবে তায়াম্মুম করে নামায আদায় করতে হবে। অসুস্থতার কারণে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা সম্ভব না হলে বসে আদায় করতে হবে। যদি বসে বা শুয়েও নামায আদায় না করা যায়, তবে ইশারায় নামায আদায় করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই নামায ত্যাগ করা জায়েয নয়।
এবার রয়ে গেল বেনামাযীর জানাযার নামায আদায় করা যাবে কিনা, এই বিষয়টি। যারা বেনামাযীকে কাফের বলে না; বরং ফাসেক বলেন, তাদের মতে, বেনামাযীর জানাযা আদায় করা যাবে। যারা বেনামাযীকে কাফের বলে, তাদের মতে, বেনামাযীর জানাযা আদায় করা যাবে না। আর যারা বেনামাযীকে কাফের বলে, তাদের অভিমত হল, সমকালীন শাসক বা বিচারক নামায আদায়ের জন্য বললেও সে নামায আদায় করতে অস্বীকার করে। এতে সমাজে সে কাফের হিসেবে চিহ্নিত হবে। এমনটি না করা হলে তার সাথে কাফেরের মতো আচরণ করা হল না।

ফাতোয়া: ইউসুফ আল কারদাওয়ী

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: