লুজান চুক্তির শতবর্ষ : এরদোগানের তুরস্ক এবার কোন পথে?

মুদাসসির নিয়াজ

২৩ জুলাই ২০২৩ লুজান চুক্তির ১০০ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। ২৪ জুলাই ১৯২৩ তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমাদের এই চুক্তি হয়েছিল। শতবর্ষ আগে সই হওয়া এই চুক্তির ভবিষ্যত নিয়ে এখন নানা মুনির নানা মত, চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা। এই চুক্তিকে কেউ বলেন বিতর্কিত, কেউ বলেন ঐতিহাসিক, কেউবা আবার বলেন কুখ্যাত। কারণ, এই চুক্তির কারণেই এতকাল তুরস্ক একরকম প্রতিবন্ধী হয়ে ছিল। কারও মতে, এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তুরস্কে ইসলামী ঐতিহ্যবাহী খিলাফত ফিরে আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। কেউ বলছেন সিরিয়া, ইরাকের মতো নিকট প্রতিবেশি কয়েকটি দেশের সীমান্ত সংলগ্ন কিছু ভূখণ্ড দখল করে ইসরাইলের আদলে গড়ে উঠবে গ্রেটার টার্কি বা বৃহত্তর তুরস্ক। কেউবা বলছেন, লুজান চুক্তির কারণেই তুরস্ক তার নিজস্ব ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এতকাল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করতে পারছিল না। তাই এবার তুরস্ক সরকার সেই অধিকার ফিরে পাবে।

কারও কারও মতে, লুজান চুক্তি হল অটোমান সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান অনেক আগেই এই তত্ত্ব খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, শেষ নয়, ২০২৩ থেকেই শুরু হবে নতুন তুরস্কের পথচলা। লুজান চুক্তিকে ঘিরে নানা স্বাদের মুখরোচক সংবাদ ও আন্দাজ-অনুমান নির্ভর হরেক কিসিমের কিসসা কাহিনি ইথার-তরঙ্গে ঘোরাফেরা করছে। মিডিয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সবার ঘুম কেড়ে নিয়েছে লুজান চুক্তি ও বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার ইউরেশিয়ার দেশ তুরস্ক এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ভবিষ্যত।

মনে রাখতে হবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন ঘটে যায়। আরও একবার একচেটিয়া ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। একদিকে নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও রাশিয়া। অন্যদিকে পতন ঘটে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজত্ব করে আসা অটোমান সাম্রাজ্য বা খিলাফতী শাসনের। বদলে যায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্রোনোলজি।

উল্লেখ্য, চলতি বছর লুজান চুক্তির শতবর্ষে পদার্পণের মাত্র এক মাস আগে তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এরদোগান পরপর ষষ্ঠবার নির্বাচিত হয়েছেন। স্বভাবতই অনস্বীকার্য যে, ২০২৩ তুরস্কের অভ্যন্তরীন রাজনীতির জন্য অন্যতম মাইলফলক হতে চলেছে। এখন লক্ষ ডলারের প্রশ্ন হল, আন্তর্জাতিক মঞ্চে সুকৌশলী ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিশ্বমানের রাষ্ট্রনেতা তথা বিচক্ষণ কূটনীতিবিদ হিসেবে উঠে আসা এরদোগানের পরবর্তী লক্ষ্য কী হতে পারে?

উল্লেখ্য, সুইৎজারল্যান্ডের লুজান শহরে সই হওয়া এই চুক্তির মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছিল বর্তমান তুরস্কের সীমানা। অর্থাৎ তথাকথিত আধুনিক তুরস্কের জন্ম হয় এই চুক্তির মাধ্যমে। ১৯২২ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) শেষ হয়েছে মাত্র বছর চারেক আগে। কিন্তু ইউরোপের কিছু কিছু জায়গায় তখনও ইতিউতি সংঘাত-সংঘর্ষ চলছিল। ইতিমধ্যে সুবিশাল উসমানীয় সম্রাজ্য ভেঙে খান খান। পশ্চিমাদের মদদে ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকায় উসমানীয়দের অধীন থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠিত হয়েছে প্রায় ৪৫ টার মতো নতুন রাষ্ট্র।

ইস্তান্বুলে শেষ উসমানীয় সুলতান ওয়াহেদ উদ্দিন কার্যত নিষ্ক্রিয়, ক্ষমতাহীন। মিত্রশক্তির হাত থেকে শেষ ভূমিটুকু রক্ষায় মরণপণ লড়াই করছেন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুর্কি সেনারা। পরাশক্তির বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্যও পেয়েছে তারা। গ্রীকদেরকেও তাড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে।

১৯২২ সালের ২৮ অক্টোবর মিত্রশক্তির পক্ষ থেকে তুর্কিদের কাছে বৈঠকে বসার প্রস্তাব দেওয়া হয়। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাবসানের লক্ষ্যে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়। দাওয়াত দেওয়া হয় আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন তুর্কি সরকারকে এবং নিভু নিভু উসমানীয় সালতানাতের শেষ সুলতানকেও। কিন্তু এই দাওয়াত আসার মাত্র তিন দিনের মাথায় আতাতুর্ক উসমানীয় সালতানাতকে বিলুপ্ত ঘোষণা করলে বৈঠকে শুধুমাত্র তার নেতৃত্বাধীন সরকারের যোগ দেওয়ার পথ প্রশস্ত হয়।

১৯২২ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ৮ মাস ধরে চলে দর কষাকষি। অবশেষে ২৪ জুলাই ১৯২৩ স্বাক্ষরিত হয় লুজান চুক্তি। একদিকে ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী তুরস্কের প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, গ্রিস, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিরা।

উল্লেখ্য, চুক্তিপত্রে কোথাও লেখা নেই যে, লুজান চুক্তি ১০০ বছর পরে শেষ যাবে। এ নিয়ে তুরস্কের খ্যাতনামা ঐতিহাসিকরাও স্পষ্ট বলেছেন, লুজান চুক্তি ১০০ বছর পরে শেষ হওয়া নিয়ে কোথাও কিছু লিখিত নেই। এসব মনগড়া, বানোয়াট এবং গুজব।

পশ্চিমাদের আশঙ্কা, ২০২৩ সালে তুরস্কে নাকি খিলাফত ফিরে আসবে। এটাও অবশ্য রটনা। তার থেকেও বলা ভাল, এরদোগানের শাসন পরিচালনার রীতিনীতি দেখে আতঙ্কিত পশ্চিমারা এই গুজব রটিয়েছে বা এই আজগুবি তত্ত্ব আমদানি করেছে।

অনেকের মতে, আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো এমনিতেই ১০০ বছর পরে শেষ হয়ে যায়, এটাই প্রচলিত রীতি বা প্রথা। যদিও একথাও সর্বৈব সঠিক নয়। কারণ, একবিংশ শতাব্দীতেও বিশ্বে অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি আছে, যেগুলো একশ বছর অতিক্রম করেও বলবৎ আছে। মনে রাখতে হবে, লুজান চুক্তি মূলত একটা শান্তি চুক্তি। আর শান্তি চুক্তি শেষ হয় কেবল যুদ্ধ পুনরাবৃত্ত হলেই।

লুজান চুক্তির ৯৯তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে গতবছর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছিলেন, ২০২৩ সালে মহাসমারোহে এই চুক্তির ১০০ বছর উদযাপন করা হবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও অখণ্ডতাকে অক্ষুণ্ন রাখা এবং শান্তি, কল্যাণ ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে কারো হুমকি, ভয় দেখানো এবং ব্ল্যাকমেলিংয়ের কাছে মাথা নত করা হবে না। এসব নীতিমালা রক্ষা করতে আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক যথোচিত পদক্ষেপ করা হবে।

সবশেষে যেকথা না বললেই নয়… সেটা হল এরদোগান খুব একটা কাঁচা খিলাড়ি নন। বর্তমান বিশ্বে যেসব রাষ্ট্রপ্রধানগণ ক্ষমতায় রয়েছেন তাঁদের অনেকের থেকেই অনেক বেশি দক্ষ, যোগ্য ও অভীজ্ঞ তিনি। একমাত্র ব্যতিক্রম রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৯ সালে। আর এরদোগান ক্ষমতাসীন হন ২০০৩ সালে। তবুও পুতিন একাধিকবার বলেছেন, এরদোগান হলেন বিশ্বমানের রাষ্ট্রনেতা। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একবার বলেছিলেন, এরদোগানকে দেখে আমি অবাক হই। কীভাবে উনি ইসলাম এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে এত সুষ্ঠু সমন্বয় বা সেতুবন্ধন করে চলেছেন। উল্লেখ্য, ৬৯ বছর বয়সি এরদোগান একটানা ২ দশক শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন।

তিনি কারও দয়ায় বা আনুকূল্যে মসনদে বসেননি। আরব দেশগুলোর রাজা-বাদশাহদের মতো উত্তরাধিকার সূত্রে গদ্দিনশীন হননি। রীতিমতো প্রত্যেকটা নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লড়াই করে জিতে এসেছেন। তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রুটি, লেবু বিক্রি করেছেন। হকারি করে সংসার চালিয়ে জীবনযুদ্ধে রীতিমতো সংগ্রাম করে এই জায়গায় উঠে এসেছেন। অর্থাৎ এরদোগানের বায়োডাটায় বংশ মর্যাদা, আভিজাত্য বা কৌলীণ্যের লেশমাত্র নেই। আর এটাই মূলত পশ্চিমাদের গাত্রদাহের কারণ। হকার থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া এরদোগানকে তারা অস্পৃশ্য, অচ্ছুত, ম্লেচ্ছ ভাবলেও সেই এরদোগান কালক্রমে মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদী ও অপ্রতীম নেতা হয়ে উঠেছেন। এমনকী জেরুজালেম, গোলান মালভূমি ইত্যাদি ইস্যুতে রাষ্ট্রসংঘে প্রস্তাব পাস করিয়ে আমেরিকা-ইসরাইল জুটিকে চোখের জলে নাকের জলে করে ছেড়েছেন। তাই পশ্চিমাদের চোখের বালি এরদোগান। অগত্যা এরদোগানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে নানারকম ছক কষেই চলেছে পশ্চিমারা। কিন্তু এরদোগান তাঁর ক্যারিশমার জোরে এবং ধুরন্ধর রাজনীতি ও কূটনীতির বদৌলতে পশ্চিমাদের সব চাল বানচাল করে দিয়েছেন।

২০১৬ সালে রাতারাতি সেনা অভ্যুত্থানের পাঁয়তারাকেও ব্যর্থ করে করে গণতন্ত্রের শাসন জারি রেখেছেন এরদোগান। অর্থাৎ এরদোগানকে নাকাম করতে পশ্চিমাদের সবরকম নীলনকশা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে এরদোগানের প্রভাব ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। আজারবাইজান বনাম আর্মেনিয়া যুদ্ধে মধ্যস্থতা করে সফল হন এরদোগান। তারই জেরে তুরস্কের উদ্যোগে সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবসানের লক্ষ্যেও কয়েকদফা বৈঠক হয়। যদিও ১৬ মাস ধরে সেই যুদ্ধ এখনও পুরোপুরি থামেনি।

প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরদোগান ও তাঁর সরকার যেভাবে ত্রাণ, উদ্ধারকাজ, পুনর্বাসন তথা মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, তা নজিরবিহীন। রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট বলছে, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে সবথেকে বেশি মানবিক সহায়তা দিয়ে চলেছে এরদোগানের সরকার। এরকম বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরদোগান যেভাবে একবিংশ শতকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছেন, তা সত্যিই ঈর্ষণীয়। আর এই শক্তপোক্ত বুনিয়াদের কারণেই এখনও পর্যন্ত পশ্চিমারা এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত বা তুরস্কে রিজিম চেঞ্জ করার স্পর্ধা দেখাতে পারেনি।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: