ইনফাক ফী সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে ব্যয় কেন করবেন? করলে কী পাবেন?

আবদুস সুবহান

ইসলামী আন্দোলনের যথার্থ প্রস্তুতি নিতে হলে বর্তমান যুগ সন্ধিক্ষণে এই আন্দোলনের প্রতিপক্ষকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। তাদের প্রস্তুতিরও যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে। ইসলামী আন্দোলন বর্তমান বিশ্বে যে দেশেই পরিচালিত হোক না কেন, তার প্রধান প্রতিপক্ষ দুই পরাশক্তি রাষ্ট্র ও তার প্রভাব বলয়াধীন রাষ্ট্রশক্তি এবং রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। এই প্রতিপক্ষ সার্বিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামের পুনর্জাগরণ ঠেকানোর লক্ষ্যে অতিসক্রিয়। তাদের পারস্পরিক স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকলেও ইসলামের ইস্যুতে প্রায় সর্বত্র তারা এক ও অভিন্ন ভূমিকা পালন করে থাকে। গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজির কারণে কোথাও কোথাও কিছুটা ভিন্ন ভূমিকা পরিলক্ষিত হলেও সেটা বাহ্যিক। মূলত ইসলামী পুনর্জাগরণ ও আন্দোলনকে ঠেকাবার ব্যাপারে তাদের কোন শৈথিল্য নেই। তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তারা বিশ্বের প্রচারমাধ্যমসমূহ ইহুদিদের সহায়তায় ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে।

মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে চিন্তার বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য রীতিমতো ইন্টেলেকচুয়াল এবং কালচারাল আগ্রাসন চালাচ্ছে। (বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন) বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে তাদের মানসিক গোলামে পরিণত করেছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে প্রশাসনকে পর্যন্ত ব্যবহার করছে। এনজিওর জাল বিস্তার করে সামাজিকভাবে প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টার পাশাপাশি আমাদের স্বকীয় ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংসের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। সেই জালে বুদ্ধিভিত্তিক ও বস্তুগত সহযোগিতা দিয়ে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে এবং তাদের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের উপর সরাসরি আঘাত হানার ব্যবস্থা করছে। এদের বহুমুখী রণকৌশলকে সামনে রেখে ইসলামী আন্দোলনের কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুনিয়ার কোন শক্তি না বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে সাহায্য করতে পারে, না বস্তুগত দিক দিয়ে কোন সহযোগিতা করতে পারে।

একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে ইসলামী আন্দোলনের নিজস্ব জনশক্তি এর প্রস্তুতি গ্রহণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই সঙ্গে সাধ্যমত ইসলামী জনতাকেও সহায়ক শক্তি হিসেবে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। সে-দিনে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথীদের তুলনায় তার প্রতিপক্ষ সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিপত্তির অধিকারী ছিল, ধনবল ও জনবলে বলীয়ান ছিল। মদীনায় হিজরতের পর প্রতিপক্ষের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। মক্কায় থাকা অবস্থায় প্রতিপক্ষ বলতে ছিল মক্কার প্রভাবশালী, সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ ও তাদের প্রভাবাধীন জনগণ। মদীনায় হিজরতের পর সেখান থেকে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল মুনাফিক গোষ্ঠী ও ইহুদিদের শক্তি। তার সঙ্গে প্রতিপক্ষ হিসাবে সামনে এল রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য। যাদেরকে আধুনিক বিশ্বের দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়।

ইতিহাস সাক্ষী, এইসব প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) প্রস্তুতি গ্রহণ করতে গিয়ে নিজস্ব জনশক্তির বাইরে কারো সাহায্য-সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হননি। যারা ঈমান এনেছে, তারাই এ আন্দোলনের জনশক্তিতে পরিণত হয়েছে, তারাই প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় একদিকে যেমন জান বাজি রেখে লড়াই করতে প্রস্তুত হয়েছে, তেমনি এই লড়াইয়ে যাবতীয় উপায়-উপকরণ ও রসদ সামগ্রী জোগাড় করার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে অর্থ বা ধন সম্পদের কুরবানী পেশ করেছে। আমাদের আজকের ইসলামী আন্দোলন মূলত আল্লাহর রাসূল (সাঃ) পরিচালিত সেই আন্দোলনেরই উত্তরসূরী। দুনিয়ার আর কোন আন্দোলনের সঙ্গে এর সামান্যতম সাদৃশ্যও নেই। অতএব আল্লাহর রাসূল ও তাঁর হাতে গড়া সাথী-সঙ্গীদের সৃষ্টি করা সেই ঐতিহ্য পুনর্জীবিত করতে পারলে এই আন্দোলনের নিজস্ব শক্তি ও গতি সৃষ্টি হবে এবং ধাপে ধাপে সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হবে।

আল্লাহর রাসূল এবং সাহাবায়ে কেরামগণের সেই ঐতিহ্যের অনুসরণে আজকের দিনে আল্লাহর কিছু বান্দার পক্ষ থেকে যেমন শহীদী খুনের নজরানা পেশ করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি তাদের ঐতিহ্য অনুসরণ করে হযরত খাদিজা, আবু বকর, ওমর ও ওসমান (রাঃ)-র মতো নজীর স্থাপনের জন্য আল্লাহর কিছু বান্দাদের এগিয়ে আসা কি অসম্ভব? মূল দাবি যেহেতু আল্লাহর কাছে জান ও মাল সোপর্দ করা, ইসলামের বাস্তব কাজ যেহেতু আল্লাহর এবাদত এবং বান্দাদের সেবা করা, সেহেতু মুসলিম সমাজের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে অর্থ ব্যয় করার প্রবণতা ঐতিহ্যগতভাবে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। ‘নদী মরে গেলেও রেখা থাকে’ এই প্রবাদ বাক্যের মতোই মুসলিম সমাজ তার নিজস্ব মূল্যবোধ প্রায় হারিয়ে ফেললেও তাদের প্রবণতা বা ঐতিহ্য একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

ইসলাম অর্থ সম্পদের কুরবানীর দু-ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে। একটা বাধ্যতামূলক যেমন যাকাত। অপরটি স্বেচ্ছামূলক যেমন গরিব, নিকট আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে দুস্থ অসহায় মানুষের সাহায্য সহযোগিতা করা, কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন মসজিদ-মাদ্রাসা প্রভৃতি কায়েমের কাজে অর্থ ব্যয় করা, স্বেচ্ছায় নিঃস্বার্থভাবে অর্থ ব্যয়ের মন মানসিকতা তৈরীর ক্ষেত্রে অবশ্য বাধ্যতামূলক দান খয়রাত ও যাকাতের একটা ভূমিকা আছে। এবং সত্যি বলতে কী; প্রতিদানের আশা ছাড়া, কোন বৈষয়িক স্বার্থ ছাড়া মানুষ অর্থ ব্যয়ে অভ্যস্ত হোক। এটা দান বা যাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য। যাই হোক বাধ্যতামূলক দান অর্থাৎ যাকাতের যে আটটি খাত আছে – তার মধ্যেও ফী-সাবিলিল্লাহর একটা খাত আল্লাহ রেখেছেন। মানুষ স্বেচ্ছামূলকভাবে যে বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করে থাকে, তার মধ্যেও ফী-সাবিলিল্লাহর খাতে বা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ আছে। শুধু সুযোগ আছে তাই নয়; বরং কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, আল্লাহর পথে জিহাদ হল সর্বোত্তম আমল।

অতএব এই সর্বোত্তম আমলের জন্য অর্থ ব্যয় হবে সর্বোত্তম খাতে – এটাই স্বাভাবিক। যে দেশে আল্লাহর দ্বীন কায়েম নেই, সেখানে যাকাতের আটটি খাতের মধ্য থেকেও                  ফী-সাবিলিল্লাহর খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দ্বীন কায়েম না হলে যাকাতের উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে দানের সকল দিক ও বিভাগের তুলনায় আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে দান করাই সর্বোত্তম দান, যে কোন দানের তুলনায় সওয়াব হবে সবচেয়ে বেশি। আজ ইসলামী আন্দোলনের কাজে টাকা দেওয়াকে অনেকে রাজনৈতিক দলে চাঁদা দেবার শামিল মনে করে। সর্বোত্তম সওয়াবের কাজ তো দূরের কথা, আদৌ সওয়াব হয় কিনা – এ সম্পর্কে সন্দেহ সংশয় পোষণ করেন। অথচ আল্লাহ তালার ঘোষণা: আল্লাহর দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে অর্থ ব্যয় সওয়াবের দৃষ্টিতে যেমন সর্বোত্তম কাজ, তেমনি কুরআন হাদীসের আলোকে এই পথে অর্থ ব্যয়টাই কার্যকর এবং অর্থবহ। নামাযের উদ্দেশ্যে মসজিদ তৈরীর কাজে অর্থ ব্যয় নিঃসন্দেহে ভাল কাজ, সওয়াবের কাজ। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন কায়েম না হলে মসজিদে তো সত্যিকার অর্থে নামায কায়েম হবে না।

আমরা মাদ্রাসার জন্য খরচ করে থাকি। আরো খরচ করা উচিত। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন কায়েম না হলে এই শিক্ষা আমাদের সমাজে যথার্থ গুরুত্ব যেমন পাবে না, তেমনি এই শিক্ষা বাস্তবে কোন কাজেও লাগবে না। আমরা এতিমখানা তৈরি করে সমাজের এতিমদের পুনর্বাসনের কাজে অর্থ ব্যয় করে থাকি এবং সেবামূলক কাজ। কিন্তু সমাজের সকল ছিন্নমূল ও অভাবগ্রস্ত লোকেদের মৌলিক চাহিদা পূরণের কাজটি তো ইসলামী সমাজ বিপ্লবের আগে মোটেই সম্ভব নয়। আমরা সকলে সম্পদ ব্যয় করেই যদি অভাবী লোকেদের অভাব পূরণ করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে এসব চেষ্টা নিষ্ফল ও অনুৎপাদনমুখী। এভাবে সওয়াবের নিয়তে এবং মানবতার সেবার নিয়েতে আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক সাহায্য সহযোগিতা দানের যতটুকু রেওয়াজ চালু আছে –এটা নিঃসন্দেহে একটা ভাল দিক। এইভাবে যারা দান খয়রাত করতে অভ্যস্ত তাদের দান খয়রাতকে আল্লাহ কবুল করুন। সাথে সাথে আমরা এই দোয়াও করি যে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে সর্বোত্তম খাতে, অর্থবহ খাতে ও উৎপাদনমুখী খাতে অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে অর্থ ব্যয়ের তাওফীক দিন, তাদের এই পথের যথেষ্ট গুরুত্ব উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: