ড. নূরুল ইসলাম
সুদীর্ঘ সময় থেকে বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ম ও বর্ণের ভিত্তিতে একে অপরের মধ্যে স্বার্থ সংঘাত অব্যাহত। একে অপরকে অবদমিত করার দীর্ঘমেয়াদি লড়াই চলছে। এমনকি, এভাবে এক জাতিগোষ্ঠী অপর জাতিগোষ্ঠীর ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় একটি জাতিগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এসব মামুলি ব্যাপার। যেমন, আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ, ইউরোপে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ, আরবে আরব ও অনারব, আর ভারতে বর্ণ হিন্দু বনাম নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের ইতিহাস সুপ্রতিষ্ঠিত। সমাজ বিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে বহু গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন। এসব সমস্যা সুরাহার চেষ্টা করেছেন। এভাবে সভ্য সমাজে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। একশো শতাংশ সম্ভব না হলেও বহু দেশে এসব দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার একটি আপাত ও আপেক্ষিক সমাধান সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এসব সমস্যার সুরাহা করার কথা জোর দিয়ে বলা হয়।
এ প্রসঙ্গে ভারতের সনাতন সমাজ ব্যবস্থায় যে বৈষম্য ও বিভেদের জড় সুপ্রতিষ্ঠিত, তা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। সবচেয়ে প্রাচীন। সবচেয়ে কঠোর। সবচেয়ে নিকৃষ্ট। সুপ্রতিষ্ঠিত। সুপরিকল্পিত। এদেশের সনাতন সমাজ ব্যবস্থায় একটি সম্প্রদায় ধর্মের ঠিকাদার। পৌরহিত্য তাদের বংশানুক্রমিক অধিকার। তাদের বিশ্বাস, তারা ঈশ্বরের বিশেষ সৃষ্টি। ঈশ্বরের বরপুত্র। তারা সকলেই নিষ্পাপ। পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে তারা শ্রেষ্ঠ। সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের কর্তৃত্ব হবে প্রশ্নহীন। প্রশ্ন করাও পাপ। বিস্ময়কর এই যে, এদেশের এই সনাতন বিভেদ ও বৈষম্য ধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত। বর্ণ বৈষম্য তথাকথিত হিন্দু ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেকোন মানুষ তাদের হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করতে পারে না। অবৈধ। পৌরহিত্য শুধু একটি বর্ণের জন্য সুনির্দিষ্ট। কঠোরভাবে অনুসৃত।
এই অসভ্য ব্যবস্থার শিকার এদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। যারা হিন্দু শাস্ত্র মতে শূদ্র। এরা হিন্দু সমাজে অশুদ্ধ ও অস্পৃশ্য। তাদের ধর্ম পালন করার অধিকার সংকুচিত। তাদের সম্পদ অর্জন ও সংরক্ষণের অধিকার সংকুচিত। তারা মানুষ নয়, রাক্ষস নামে পরিচিত। ঘৃণা প্রকাশের এমন কোন শব্দ নেই, যা তাদের সম্পর্কে ব্যবহার করা হয় না।
এভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই প্রথা, এই অনুশাসন। কত কোটি মানুষ এই অপশাসনের শিকার হয়েছেন, তার পরিসংখ্যান দেওয়া অসম্ভব। হাজার হাজার বছর ধরে চলছে। এই উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এই সিষ্টেম ফুলপ্রুফ ও পরীক্ষিত।
যে প্রক্রিয়ায় এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে যারা দলিত বানিয়েছে, ঠিক তারাই আজকে এদেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে দলিত শ্রেণিতে পরিণত করতে সর্বাত্মক ধর্ম-যুদ্ধ শুরু করেছে। তাদের এই প্রক্রিয়া যেহেতু পরীক্ষিত, তাই তারা সফল হতে শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ঘৃণা। ঘৃণা আর ঘৃণা। সবচেয়ে বড় মারণাস্ত্র! তারা এই মারণাস্ত্র এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সফল প্রয়োগ করে চলেছে। দ্বিতীয়ত বিদ্বেষ। সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন বিদ্বেষ। কাউকে হত্যা করাও পুণ্যের কাজ – এই বিশ্বাস সৃষ্টি করা। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এই মূলনীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে। তিন) মিথ্যা আখ্যান নির্মাণ। যেমন রাবণ ও রাক্ষসের আখ্যান সৃষ্টি করে এদেশের আদিবাসী অনার্যদের বিষয়ে আখ্যান নির্মাণ করা হয়েছে। এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তথাকথিত জিহাদ ও সন্ত্রাস ইত্যাদি আখ্যান নির্মাণ করে মিথ্যা প্রচারণা ও প্রোপাগান্ডা শুরু করেছে। চতুর্থত, অধিকার বঞ্চিত করা। সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। শূদ্র সম্পদ সংরক্ষণ করতে পারে না। মুসলিম সম্প্রদায় কলি যুগের শূদ্র। তাদের সম্পদ সংরক্ষণের অধিকার নেই! তাই, তাদের সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে অধিকার সংকুচিত হয়ে আসছে। ব্যবসা ও বাণিজ্যে তাদের উৎখাত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পঞ্চমত, সহিংসতা। ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে বিনাশ। তারা নিজস্ব সশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত বাহিনী গঠন করে ফেলেছে। তাদের সক্ষমতা পরীক্ষার জন্য মুসলিম হত্যা করে চলেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। পাল্টা প্রতিরোধ ও প্রতিঘাত মাপতে চাইছে।
এই নির্মম দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলাকালে তথাকথিত শূদ্র সমাজের পক্ষ থেকে কোন সফল আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। ফলে, হাজার হাজার বছরের গ্লানি ও দুঃখ-কষ্ট তাদের চিরন্তন সাথী হয়েছে। অপমান ও অন্যায় চিরসঙ্গী হয়েছে। অনুরূপ, মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কোন সফল আন্দোলন গড়ে না ওঠার জন্য তাদের মিশন এখন প্রায় সফল। ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় এখন শূদ্রকরণ প্রক্রিয়ার অন্তিম লগ্নে। এই মুহূর্তে, তারা হিন্দু শূদ্রদের থেকেও বেশি শূদ্র। হিন্দু শূদ্রদের তুলনায় বেশি ঘৃণার শিকার। বেশি বৈষম্যের শিকার। বেশি সহিংসতার শিকার। বেশি পিছিয়েপড়া। এসব পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, মুসলিম দলিতকরণ বা শূদ্রকরণ প্রক্রিয়া দারুন সফল!