বাংলায় দ্বীনী চেতনায় ওলামা সমাজ

মোঃ তাহেরুল হক
ভাষা মানুষের মনের আশা-আকাঙ্খা ও সুখ-দুঃখ প্রকাশের মাধ্যম। হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে যখন ভাষার কারুকার্যময় বর্ণনা, রূপ-রস এবং রূপকের মাধ্যমে মানুষের জন্য আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করে পেশ করা হয়, তা হয়ে যায় সাহিত্য।
বঙ্গে মুসলিম আগমন সপ্তম শতক হলেও বাংলা ভাষার সঙ্গে মুসলিমদের বিকাশ শুরু হয়েছে ত্রয়োদশ শতকের শুরু থেকে। কেননা, মুসলিম শাসন ব্যবস্থার শুরুর আগে বাংলার রাজন্যবর্গদের নিকট বাংলা ভাষা ছিল গ্রাম্য ও নিম্ন শ্রেণির মানুষের ভাষা, আর রাজকীয় ভাষা ছিল সংস্কৃত, যা হিন্দু উচ্চশ্রেণিই ব্যবহার করত। ১২০৬ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী ১৭ জন সিপাহশালার নিয়ে বঙ্গ বিজয় করার পর বাংলা ভাষা বিকাশের ‘সুবহে সাদেক’ লাভ করে। পূর্বে বাংলা ভাষা ছিল সংস্কৃত ঘেঁসা। এজন্য ইসলাম বিশেষজ্ঞ এবং ওলামা সমাজও ইসলামী শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করেনি; বরং বয়কট করেছিলেন। অপরদিকে সাড়ে পাঁচশত বছরের বাংলার মুসলিম শাসকগণ মূলত ফারসি ভাষাকে রাজকীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা দিয়ে এসেছে। যদিও গণজীবন ও প্রজাবর্গের সঙ্গে নিজেদের নিবিড় সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করার জন্য বাংলা ভাষাকে মার্জিত ও তার গ্রহণযোগ্যতাকে পরিশীলিত করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা প্রশংসাযোগ্য।
এই একবিংশ শতকেও মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা বেশী একটা হয়নি। ফলে ইসলাম অনুবাদ-নির্ভর হয়ে আছে। মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা থাকায় মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চায় ঘাটতি আছে। একটা জাতিসত্তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক জগতে সেই জাতির মানোন্নয়ন করার জন্য সাহিত্য-সংস্কৃতির অপরিহার্য ভূমিকা আছে। এমতাবস্থায় ওলামা সমাজকে ইসলামের মেরুদণ্ড বলা হলেও ঘাটতিটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। যে প্রেক্ষাপটেই হোক, ১৭৮০ সালে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু নিশ্চয়ই ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আলিয়া মাদ্রাসায় বাংলা ভাষা পড়ানো হত না। ১৯৭৩ সালে ছাত্র আন্দোলনের ফলে বাংলা ও ইংরেজিকে উর্দু-ফার্সির সঙ্গে ইলেকটিভ ভাষা হিসেবে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইতিপূর্বে শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু ভাষা এবং শিক্ষার্থীদের ৯০ শতাংশের বেশি ছিল না বাংলাভাষী। ২০০৫-০৬ সালের পর আলিয়া মাদ্রাসার সকল পরীক্ষার্থী মাতৃভাষা বাংলায় উত্তরপত্র লেখার অনুমতি লাভ করে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দেড় হাজারের বেশি নিজামিয়া বা খারেজী মাদ্রাসা আছে। আজও যার মাধ্যম উর্দু ভাষা। এরও কারণ আছে। সিলেবাস-পাঠ্য পুস্তকের বাংলা অনুবাদ তেমন ছিল না এবং শিক্ষকগণের বাংলা ভাষার প্রতি দুর্বলতা থেকে গেছে। তাঁরাও বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার্জনের সুযোগ পাননি। মাতৃ ভাষায় শিক্ষার চর্চা বাড়াতে হবে।
ভাষা আল্লাহর দান:
সকল ভাষা আল্লাহর দান। আল্লাহ বলেন: (১) তিনি অতি দয়াময় যে কুরআনের শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সৃষ্টি করে তাকে কথা বলার শিক্ষা দিয়েছেন। (৫৫:১৪) এখানে নিছক কথা বলা নয়; বরং মনের ভাব প্রকাশের উপযুক্ত বর্ণনা কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন।
(২) আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি, আর বর্ণ ও ভাষার বৈচিত্র্য; এর মধ্যে সব মানুষের জন্য রয়েছে অসংখ্য নিদর্শন। (৩০: ২৭-২৮)
(৩) উপদেশ গ্রহণের জন্য কুরআনকে সহজ মাধ্যম বানিয়েছি। তার থেকে উপদেশ গ্রহণে কেউ কি প্রস্তুত আছ? (৫৪: ১৭; ২২; ৩২; ৪০) এছাড়াও ইসলামের মৌলিক বাহক নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে বলেন: (৪) আমি একজনও নবী-রসূল পাঠাইনি, যিনি তাঁর গোষ্ঠীর ভাষাকে মাধ্যম হিসাবে প্রচার করেননি। যাতে করে তারা আল্লাহর বাণীকে স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে। (১৪: ৪)
ইসলাম কোনো একটা নির্দিষ্ট ভাষাকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড বানায়নি। সব ভাষাই আল্লাহর নিয়ামত, আল্লাহর দান। যার যেখানে জন্ম, সেখানকার ভাষা উপেক্ষা করলে তারই ক্ষতির সম্ভাবনা বেশী। এই বাস্তবতাকে অবহেলা করার কারণে বাংলায় ওলামা সমাজে সাহিত্য, দ্বীনী চেতনায় স্বল্পতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আজকাল অনেকেই ভাবেন সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে ধর্ম পরিপন্থী। অথচ আল কুরআনের সাংস্কৃতিক চেতনা হল প্রাত্যহিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার মৌলিক আদর্শ ও নীতিমালা মেনে চলতে হবে। এটাই তার মূল্যবোধ। প্রকৃত ধর্ম-দর্শনের চেতনা মানুষকে কখনো একদর্শী ও সাম্প্রদায়িক বানায় না। বিচ্ছিন্নতারও জন্ম দেয় না; বরং মানবতার ঐক্যের বার্তা দেয়। তাই আমাদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে সমাজ দর্শনের মূল্যবোধকে উৎসাহিত করার জন্য ভাষা বর্ণনার কৌশলে এবং শালীন মাধ্যমে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। জীবন ও জগতের বাস্তবতা এবং মানবীয় জীবনের মৌলিক লক্ষ্য ও অনুভবকে ভাষা, ছন্দ, রূপক ও অলঙ্কারের মাধ্যমে প্রকাশ করাই সাহিত্য। একজন সাহিত্যিক মনের পাতায় জীবনের ছবি আঁকেন। বিশ্বে প্রায় চার হাজারেরও বেশী ভাষা আছে — তার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান ৭ম – রাষ্ট্রসঙ্ঘের স্বীকৃত ভাষাও।
বাংলায় ইসলামী চেতনায় ওলামাগণ:
একথা সত্য যে, এপার বাংলায় ভাষার বিকাশ ও চেতনায় ওলামাগণের নগণ্য ভূমিকা রয়েছে। তারও পশ্চাতে আছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাক্রমের নেতিবাচক ভূমিকা। পূর্বেও শিক্ষার মাধ্যম থেকে পাঠক্রম বিষয়ে ইসলাম-প্রিয় জনতার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিত্তবান সামাজিক শিক্ষিত শ্রেণিও এ বিষয়ে সচেতন নয়।
এক অর্থে ওলামাগণ মুসলিম সমাজের দর্পণ (সমগ্র মানব জাতিরও)। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওলামা তৈরীর কারখানায় লক-ডাউন চলছে। এর জন্য নিছক তারা নয়, মুসলিম সমাজ ব্যবস্থার দুর্বলতাই দায়ী। রা্ষ্ট্র ব্যবস্থা হাতছাড়া, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডও ভেঙে আছে। ইসলামের পূর্ণ সমাজ দর্শনের চেতনায় মরু বিয়াবান। বঙ্গদেশ যখন ছিল ইংরেজদের অধীন, তাদের শত্রুপক্ষ মুসলিম সমাজের কেবল অস্তিত্ব রক্ষা নয়; বরং তাদের নিজস্ব জীবন যাপন, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ ও জমি রক্ষা থেকে শিক্ষা ও সামাজিক সংকট কালো মেঘের ন্যায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আরো বলা ভালো, ১৮৬৪ সালে মুসলিম আইন ব্যবস্থায় সরকারী বিধিনিষেধ আরোপ হয়, কুরআনের পারিবারিক ও সামাজিক নীতিমালায় সরকারী কোপ; আলিয়া মাদ্রাসায় নিছক সরকারী কর্মচারী বা কেরানী তৈরীর প্রেক্ষাপট ছিল। অন্যদিকে বাংলা ভাষায় ইসলাম বলতে ছিল পুঁথি সাহিত্য। ‘কাসাসোল আম্বিয়া’, ‘খায়রোর হাশর’, ‘সোনাভানু’ এবং পরবর্তীতে মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ ও গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’। এ রকমই ছিল মুসলিমদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ। তারপর আসে ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গের সূচনা ও তার রদের রাজনৈতিক খেলা। তারপরে দেশ ভাগের চক্রান্তমূলক বাটোয়ারা। ফলে মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণের শিরোমণি যারা — সুখের সন্ধানে চলে গেলেন ওপার বাংলায়।
এই পরিস্থিতিতে এপার বাংলায় ইসলামের চিন্তা-চেতনার বিকাশে ওলামাগণের ভূমিকার বিবরণ তরকারিতে নুনের সমান। ইংরেজ শাসনে মুসলিম চেতনা জাগবে? এমন উদ্যোগ ছিল বিষাক্ত ও বৈরী আচরণের সমান। মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষিত সমাজ উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ইসলাম ও মুসলিম ভাবাদর্শ ছেড়ে জাতীয় স্রোতে বিলীন হতে শুরু করে। অন্যদিকে ওলামাদের বৃহৎ অংশও মাতৃভাষা বাংলাকে রপ্ত না করে উর্দুকে উচ্চাসনে রাখে। ফলে ইসলাম-প্রিয় সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ময়দানে পতাকা তোলার তেমন ব্যক্তির অভাব ছিলও।
আর বিভাগোত্তোর (১৯৪৭) সময়কালে মুসলিম বুদ্ধিজীবী-শূন্য বাঙালি মুসলিম মানসে সংকটকাল শুরু হয়। মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে আবু সায়ীদ আইউব, সৈয়দ মুজতবা আলী, কাজী আব্দুল ওয়াদুদ, হুমায়ূন কবীর, রেজাউল করীম থেকে উত্তরসূরীদের বড় অংশ ইসলামী চেতনা নয়; বরং মুসলিম জাতীয় চেতনার জন্য যথেষ্ট উপাদান দিয়েছেন। মুসলিম সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ছিল হতাশাগ্রস্ত অবস্থা। আনন্দ বাজার, যুগান্তর, অমৃত বাজার, বসুমতী, কালান্তর জাতীয় পত্রিকা ছিল জাতীয়তাবাদী মুসলিম নিয়ে চলার পক্ষে। স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মুসলিম চেতনা ছিল তাদের কাছে বিচ্ছিন্নতার প্রতীক। অন্য কথায়ও ছিল সুপ্ত একটা জাতীয় বৈরিতা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী উগ্রতা। এমন সময়কালে মুসলিম সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চেতনার স্বতন্ত্র বিকাশ ঘটতে থাকে। এর মধ্যে যে ওলামাগণের অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল:
(১) মাওলানা আকরাম খাঁ:
উত্তর ২৪ পরগণার হাকিমপুরে জন্ম। মুসলিম সাংবাদিকতার জনক বলা হয়। তখন বাংলা সাহিত্যে ইসলাম ও ইসলামী জীবন দর্শনের শূন্যতা বিরাজ করছিল। আকরাম খাঁ-এর আগমন এক ধ্রুবতারার ন্যায়। তাঁর সম্পাদিত দৈনিক আজাদ, তখনকার সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকার বিকল্প হিসাবে মুসলিম সমাজে ছিল বরণীয়। তার ভাষা ও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ছিল আকর্ষণীয়। তিনি ‘তাফসীরুল কুরআন’ নামে তাফসীর সাহিত্যে বাংলা ভাষার ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন। নবী জীবনীর ‘মোস্তফা চরিত’ এবং সমস্যা ও সমাধান’ মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস নামে সাহিত্য জগতে মাইলফলক তৈরি করেছেন। এছাড়াও সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুক্তিশীল সাবলীল কলম চালিয়েছেন। সঙ্গীত সর্বদা নিষিদ্ধ নয়, ছবির প্রয়োজন ভিত্তিক ব্যবহার, চিত্রকলার শালীন উপস্থাপন এবং নাটক, অভিনয় সম্পর্কে বহু গবেষণাধর্মী মতামত রেখে গেছেন।
(২) মৌলবী মজিবর রহমান:
পৈতৃক সূত্রে বর্ধমান হলেও ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাটের নেহালপুরে জীবন কাটিয়েছেন। বাংলার জনজীবনে মুসলিম মানস নানা কারণে আঘাতপ্রাপ্ত ও হতাশাগ্রস্ত ছিল। ইংরেজি ভাষায় the Moslem নামে দৈনিক পত্রিকার ৪০ বছর যাবত সম্পাদনা ও প্রকাশনার মধ্য দিয়ে তিনি ‘আলেমানা’-র যোগ্য মর্যাদা রেখেছেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা-র কিছুকাল সম্পাদকও ছিলেন। সংশোধন, বিকাশ ও উন্নয়নের বহুমুখী ভাবনা তাঁর সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সাধনায় উপস্থাপিত হয়েছে। ইসলামী চরিত্রের মৌলিক গুণাবলী, সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জন মানসকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন।
(৩) মাওলানা আব্দুল রহিম (বরিশাল)
কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময় থেকেই তিনি সাহিত্য সাধনা করতেন। কলকাতা কেন্দ্রিক অসংখ্য মাসিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। ‘জাহানে নও’ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন দীর্ঘকাল। শতাধিক মৌলিক বই লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেনও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ আরবি, উর্দু বইয়ের।
(৪) মাওলানা আব্দুল মান্নান তালিব:
মূলত ২৪ পরগণা জেলার মগরাহাটের অর্জুনপুরে জন্ম। লেখাপড়া সূত্রে ঢাকায় ছিলেন। দেশভাগের পর স্থায়ীভাবে ওখানে থেকে যান। গবেষণাধর্মী মাসিক পৃথিবী, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা প্রভৃতির সম্পাদনা করেছেন। শত শত পৃষ্ঠা কলেবরের অর্ধশত বই লিখেছেন। বৃহৎ আকারের আরবী, উর্দু বইয়ের অনুবাদ করে সামাজিক জাগরণের রসদ জুগিয়েছেন।
(৫) মাওলানা রফিকুল হাসান:
অর্ধশতক ব্যাপী মাসিক ‘কোরআন প্রচার’ এর সম্পাদক ছিলেন। সহজ-সরল প্রকৃতির ও সাহিত্য সচেতন মানুষ হিসাবে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর চেষ্টায় অসংখ্য যুবকও সাহিত্যপ্রেমী হিসাবে গড়ে উঠেছে।
(৬) মাওলানা আশরাফ আলী:
কলকাতার চাঁদনীচক থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘নেদায়ে ইসলাম’-এর সম্পাদক। প্রায় ষাট বছর যাবত তিনিই তার সম্পাদনা করেছেন। নব্বই ঊর্ধ্ব বয়সে মারা যান।
(৭) মাওলানা মোহাম্মদ তাহের:
কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার সর্বধন্য অধ্যাপক এবং সাপ্তাহিক ‘ইনসানিয়াত’ (মানবতা) পত্রিকার সম্পাদক। জন্মস্থান আসামের কাছাড় হলেও কলকাতার ম্যাকলিয়ড স্ট্রিট এবং পরে দমদমের বাকড়া-য় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তিনি কুড়িটির মতো বই রচনা করেছেন। যেমন- মাল্টার বন্দি; রমনীর মান ইত্যাদি।
(৮) হাফেজ শায়খ আইনুল বারী আলিয়াভী:
পশ্চিম কলকাতার মেটিয়াবুরুজের মারে রোডের বাসিন্দা। সাতের দশক (১৯৭২) থেকে ‘মাসিক আহলে হাদীস’ পত্রিকার আমৃত্যু সম্পাদক। তাঁর আইনী সালাতে মোস্তফা, আইনী তাফসীর বিখ্যাত। এছাড়া অসংখ্য গ্রন্থ প্রণেতা। মুসলিম সমাজের সামাজিক জীবনে শের্ক, বেদআত ও কুসংস্কার তাতে প্রবেশ করতে না পারে, তার দিকে ছিল তীক্ষ্ম নজর। নিজের পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় ও দৈনিকে তাঁর লেখা প্রকাশ হত। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালে মারা যান।
(৯) মাওলানা আব্দুল হামিদ কাসেমী:
২৪ পরগণার মগরাহাটের অর্জুনপুরে জন্ম। আব্দুল হামিদ ছাত্র জীবন থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি সচেতন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। ১৯৭২ সালে প্রকাশ করেন ‘মাসিক তালীম’ পত্রিকা। কয়েক বছর তার সম্পাদনা করেন। তারপর মহারাষ্ট্রের এক বড় মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্থানান্তরিত হলে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্তরের পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর ‘তরতিবী নামায শিক্ষা’ উল্লেখযোগ্য।
(১০) মাওলানা আব্দুল মাতিন: শিক্ষা ও সমাজ সচেতন ব্যক্তি। ‘বঙ্গনূর’ নামে এক সাপ্তাহিকের সম্পাদনা করে চলেছেন।
(১১) মাওলানা আব্দুল রউফ শামীম:
বীরভূমের সিউড়ির অবিনাশপুরে জন্ম। নিযামিয়া মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মসূত্রে বিভিন্ন জেলায় থেকেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন স্তরের পত্রিকায় ইসলামী বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছেন। কয়েকটি বইও রচনা করেছেন। ‘ইসলামের চিকিৎসা বিজ্ঞান’ তাঁর স্মরণীয় বই।
(১২) মাওলানা আব্দুল হামিদ মাদানী:
সমাজ সংশোধন ও শিক্ষা জাগরণে সদা তৎপর। মাওলানার জন্ম বর্ধমানের আলিফনগর গ্রামে। কর্মসূত্রে সৌদিতে ছিলেন দীর্ঘকাল। অসংখ্য গ্রন্থ রচনা এবং অনুবাদ করেছেন।
(১৩) মাওলানা মুমতাজ উদ্দীন:
মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলায় জন্ম। সাহিত্য চেতনায় ছিলেন ব্যতিক্রমী মানুষ। সমাজ সংশোধন ও জাতীয় জাগরণে গ্রন্থ রচনা করেছেন।
(১৪) হাফেজ গোলাম আহমদ মোর্তজা:
বর্ধমানের মেমারীতে জন্ম। আলেম হয়েও তাঁর ইতিহাস সচেতনতা ও গবেষণা বাংলায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর লেখা ‘ইতিহাসের ইতিহাস’; ‘বাজেয়াপ্ত ইতিহাস’; ‘পুস্তক সম্রাট’ উল্লেখযোগ্য।
(১৫) ২৪ পরগণার বসিরহাটের আল্লামা রুহুল আমীন, পীর ঘরানার হয়েও সাহিত্য সাধনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। ‘মোসলেম সমাজ’ হিসেবে মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন এবং কতক দ্বীনী গ্রন্থও রচনা করেছেন।
এছাড়াও আলেম হিসেবে যারা নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতি সচেতন হিসাবে পত্র-পত্রিকায় লেখেন ও গ্রন্থ রচনা করেছেন; তাদের কয়েকজন হলেন মাওলানা হুশামুদ্দিন, মাওলানা আজিজুল হক কাসেমী (মেদিনীপুর), মাওলানা এহতেশামুল হক (হুগলী), মাওলানা বাদরুদ্দোজা নাদবী (মালদহ) এবং এ.এম.খালিদ ও মুফতী আতিকুর রহমান (দ: ২৪ পরগণা) প্রমুখ।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: