নাকবা দিবস: ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে কী ঘটেছিল?

বিশেষ প্রতিবেদন:
১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের বুকের ওপর নতুন রাষ্ট্র গঠন করে ইহুদিরা। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় তৎপরতায় ফিলিস্তিনের স্থানীয় আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে এই অবৈধ রাষ্ট্র গঠন করা হয়। উচ্ছেদের সময় সশস্ত্র ইহুদিরা লাখো লাখো ফিলিস্তিনির ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাট থেকে শুরু করে এমন কোনো নৃশংসতা নেই যা ইহুদিরা করেনি। দখলদার ইহুদিদের মাত্রাতিরিক্ত হামলায় প্রাণ ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায় লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ভূমিপুত্র। ঘরছাড়া ফিলিস্তিনিদের বেশিরভাগই আশ্রয় নেন পাশ্ববর্তী দেশ জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায়। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ৭৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছিল ইহুদিরা (এখন যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ)। এর জেরে শুরু হয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিদের জন্য শুধু অবশিষ্ট থাকে পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার কিছু জায়গা। নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে আজও চরম অনিশ্চয়তায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন নিরীহ ফিলিস্তিনের মানুষ। তাই নিজেদের ভূমি হারানোর দিন প্রতি বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি নাকবা দিবস পালন করেন ফিলিস্তিনিরা। নাকবা শব্দের অর্থ মহাবিপর্যয়। সেই অর্থে নাকবা দিবস মানে দাঁড়ায় মহাবিপর্যয়ের দিন। এই নিবন্ধে কুখ্যাত নাকবা দিবসের পেছনে যে দুর্বিষহ ইতিহাস সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।  
ইসরাইল কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি গ্রাম:
মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের পর ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ বাহিনী ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং স্বীকৃতি দেয়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রায় ৮ লাখ ফিলিস্তিনিকে ঘরছাড়া করে দখলদার ইসরাইলিরা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে ইহুদি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের প্রধান শহর ও গ্রামে আক্রমণ করে। ২ বছরে প্রায় ৫৩০টি গ্রাম ধ্বংস করে তারা। ইহুদি সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যায় প্রায় ১৫,০০০ ফিলিস্তিনি শহিদ হয়। ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল জেরুজালেমের পশ্চিম তীরে দেইর ইয়াসিন গ্রামে ইতিহাসের স্মরণকালের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা চালায় ইহুদি বাহিনী। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পূর্বেকার কথিত দেশ, ইরগুন ও স্ট্যান গ্যাং মিলিশিয়াদের হামলায় নারী ও শিশুসহ ১১০ জন নিহত হয়।
ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের নৃশংসতা নিয়ে একটি বই লিখেছেন ফিলিস্তিনি গবেষক সালমান আবু সিত্তা। ‘দ্য অ্যাটলাস অব প্যালেস্টাইন’ নামক বইটিতে তিনি ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও হত্যাযজ্ঞের জেরে ফিলিস্তিনিদের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসার রোমহর্ষক ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, ইসরাইলি দখলদারিত্বে উদ্বাস্তু হয়ে প্রায় ৬০ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ছেড়েছেন। যদিও বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অন্তত ১০ লক্ষ বেশি। তারা দীর্ঘ সাড়ে সাত দশক পরে এখনও প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে বংশ পরম্পরায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। 
ঘরছাড়া ফিলিস্তিনিরা এখন কোথায়?
রাষ্ট্রসংঘের হিসাব অনুযায়ী ইসরাইলি দখলদারিত্বে উদ্বাস্তু হয়ে প্রায় ৬০ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ছাড়েন। বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাপক উন্নতি হলেও ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের জীবনমান একবিন্দুও বদলায়নি। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা রাষ্ট্রসংঘের ত্রাণ সহায়তা দফতর বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে খাবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া অব্যাহত রেখেছে। তাদের তথ্যানুযায়ী, জর্ডানে ২৩ লাখ, গাজায় ১৫ লাখ, অধিকৃত পশ্চিম তীরে প্রায় ১০ লাখ, সিরিয়ায় ৮৭ হাজার ও লেবাননে ৫ লাখ ৮০ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে নিয়মিত সাহায্য প্রদান করা হয়।
ভূমিহীন ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরগুলোর মধ্যে জর্ডানের বাকা’আ, অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন, গাজার জাবালিয়া, সিরিয়ার ইয়ারমুক ও লেবাননের ইয়ান্দ অন্যতম। গাজার ৭০ শতাংশ বাসিন্দাই শরণার্থী। এছাড়াও গাজা উপত্যকার আশেপাশে মোট ৮টি শরণার্থী শিবিরে ১৫ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি বসবাস করেন। আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুযায়ী, ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার বৈধ অধিকার রাখেন। শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করা অসংখ্য ফিলিস্তিনি আবারও নিজেদের বাড়িতে ফেরার স্বপ্ন দেখেন। দখলদার ইহুদি কর্তৃক বিতাড়িত এই শরণার্থীরা পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবে থেকে গেছেন এখন অবধি। 
দখলদারিত্বে ফিলিস্তিনিদের জীবন:
বিগত ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদার ইসরাইলের সামরিক নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ, হামলা তাদের জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করছে। স্বাধীন দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা কোন পরিষেবাগুলো ভোগ করতে পারবে, কোথায় ভ্রমণ করতে পারবে, কাকে বিয়ে করতে পারবে এবং কোথায় বসবাস করতে পারবে এসব ঠিক করে দেয় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন জীবনে ইসরাইলের এমন নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা করেছে অনেক শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এ প্রসঙ্গে বলছে, ‘মানবতার বিরুদ্ধে বর্ণবাদ ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অপরাধ করছে ইসরাইল।’ সংস্থাটির তদন্তে উঠে এসেছে ভয়াবহ সব তথ্য। ফিলিস্তিনিদের জমি ও সম্পত্তি জবরদখল, বেআইনি হত্যা, জোরপূর্বক হস্তান্তর, আন্দোলনে নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনিক আটক এবং ফিলিস্তিনিদের নাগরিকত্ব অস্বীকার সহ আরও ভয়াবহ অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে এই মানবাধিকার সংস্থাটি।
প্রতি বছর ফিলিস্তিনিদের শত শত বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। এইচআরডব্লিউ’র হিসাব অনুযায়ী, শুধু ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৮৫০০ ফিলিস্তিনি বসতি ধ্বংস করেছে ইসরাইল। ঘরছাড়া করা হয়েছে কমপক্ষে ১২,৪৯১ জনকে। জোরপূর্বক স্থানচ্যুত করা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। দখলকৃত জায়গাসমূহকে ইসরাইল ‘এরিয়া-সি’ নাম দিয়েছে, যা সমগ্র পশ্চিম তীরের ৮০ শতাংশ। এছাড়াও ১৬০ শিশু ও ৩২ নারীসহ ৪৪৫০ জন ফিলিস্তিনিকে বেআইনিভাবে ইসরাইলে আটক রাখা হয়েছে। প্রতি বছর ১৭ এপ্রিল দিনটিকে ফিলিস্তিনিদের নাগরিকেরা ‘বন্দি দিবস’ পালন করে। 
ইসরাইলি দখলদারি থামছেই না:
আন্তর্জাতিক আইনে যে কোনো স্বাধীন দেশে জোরপূর্বক বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ। তবে এই আইনের তোয়াক্কা করছে না ইসরাইল। বিগত সাড়ে সাত দশকে বেআইনিভাবে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে নতুন করে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ইহুদিকে বসতি গড়ে দিয়েছে ইসরাইল সরকার। এসব এলাকার ভূমির মূল মালিক ফিলিস্তিনিরা। এর জেরে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে প্রায়শই দখলদার ইহুদিদের বিরোধ ও সংঘাত হয়। অবৈধভাবে বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের জন্য ইসরাইল সরকারের আলাদা কিছু তহবিল রয়েছে। এমনকি মূল ইসরাইলের তুলনায় এসব জায়গায় বসবাসকারী ইহুদিদের সন্তান নেয়ার প্রবণতাও বেশি। মূলত, ইসরাইল চাচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হাতে নিতে। 
গাজায় ভয়াবহ হামলা:
২০০৮ সালের পর গাজায় কমপক্ষে ৫ বার ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এসব হামলায় ৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এদিকে ২০০৭-২০০৮ সাল থেকেই গাজা উপত্যকায় সমুদ্র ও আকাশপথে অবরোধ করে রেখেছে ইসরাইল। গাজার সঙ্গে ইসরাইল ও মিসরের সীমান্ত রয়েছে। গাজার আয়তন মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। 
আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এই উপত্যকা বেশ জনবহুল। সময়ের নিরিখে জনসংখ্যা বাড়লেও ইসরাইলি দখলদারিত্বে ক্রমেই ছোট হচ্ছে গাজার আয়তন। ইসরাইলের এমন হত্যাকাণ্ডের জন্য গাজাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘উন্মুক্ত কারাগার’ বলা হয়। পরিশেষে বলা যায়, ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘নাকবা দিবস’ শুধুই ঐতিহাসিক একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা নয়। বরং এটি তাদের উপর চলমান বাস্তুচ্যুতির প্রক্রিয়া। ফিলিস্তিনিদের মহাবিপর্যয়ের সূচনা ৭৫ বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল, সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলছে।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: