মোঃ তাহেরুল হক
সৃষ্টির মূলে আল্লাহ এবং মানুষ। আল্লাহ চিরন্তন, আর মানুষ নশ্বর- ক্ষণস্থায়ী। আমরা মানুষ, কীভাবে কোন্ কাজে এ পৃথিবীতে এলাম এবং আকস্মিক চলেও যাব, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে অবস্থান কালে মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, তার সমীক্ষা কয়জন করে? মানুষের আসা-যাওয়া অতঃপর মৃত্যু? নিছক সব শেষে
‘শব’ হয়ে পার্থিবের শেষ? না! তারপর কর্মফলের বিচারে হবে ভোগান্তি। ভাল-মন্দের সূক্ষ্ম বিচারের ফল পেতে হবে। কুরআন বলে: যিনি জন্ম ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন- পার্থিবের কর্মক্ষেত্রে তোমাদের কে উত্তম, তা যাচাই করাই লক্ষ্য।’ (৬৭: ২)
পার্থক্য জীবন পরীক্ষা কেন্দ্র এবং জীবনের আয়ুষ্কাল পরীক্ষা কাল। এর সিলেবাস যুগে যুগে দিয়ে গেছেন নবী-রাসূলগণ। যারা সেই সিলেবাস ফলো করে নিজেদের লক্ষ্যপথে সঠিক কর্মসূচি অনুযায়ী জীবন-যাপন করবে- তারাই হবে সফল। আল্লাহ প্রত্যেক জাতির জন্য সঠিক পথ প্রদর্শক পাঠিয়েছেন। তাঁরা কী করেছেন-তাও কুরআনে বলা হয়েছে: ‘প্রত্যেক জাতির জন্য আমি রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁরা বলেছেন- এক আল্লাহর দাসত্ব করো এবং তার বিরোধী শক্তিসমূহকে বর্জন করো।’ (১৬: ৩৬) সুতরাং মানব জীবনের লক্ষ্য দুটি। এক) নিরঙ্কুশভাবে এক আল্লাহর আনুগত্য, দাসত্ব বা বন্দেগী করা। আল্লাহ ভিন্ন কারো আনুগত্য, দাসত্ব শ্রেষ্ঠত্ব, কর্তৃত্ব কোনোভাবে কাম্য নয়।
দুই) পৃথিবীতে আল্লাহ-বিরোধী সকল প্রকার শক্তিসমূহকে বর্জন করাই মানব জীবনের সঠিক লক্ষ্য। কুরআন সতর্ক করেছে যে, হে মানুষ! তোমরা কি মনে কর- আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি? তোমাদেরকে কখনোই আমার কাছে একত্রিত করা হবে না? (২৩: ১১৫) এই সতর্ক সংকেত সকল যুগের সকল দেশে আল্লাহ কর্তৃক মানবতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নবী-রাসূলগণের আগমন ঘটেছে, আমরা কুরআনের ভাষায় জানতে পারি: ‘আমি তোমার আগে অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি, তাদের কারো কারো ঘটনা আমি তোমাকে জানিয়েছি, আবার এমনও আছে যে তাদের অনেকের কথা তোমার কাছে আমি আদৌ বর্ণনা করিনি।’ (৪০: ৭৮)
সকল নবী-রাসূলগণের আগমনের মূল লক্ষ্য হল কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে মানুষকে আহ্বান করা এবং কতক বিষয়ে থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলা। এটাই গ্রহণ-বর্জনের নীতিমালা। মানুষের লক্ষ্যপূর্ণ জীবন হল- আল্লাহর আদেশ-নিষেধের দাসত্ব করা; অনুসরণ করা; পূর্ণভাবে তা মেনে চলা। এর ভিন্ন অন্য কিছু নয়।’ (৫১: ৫৬) পার্থিব জীবনে যারা আল্লাহকে অনুসরণ করে না; বরং তার সম্পর্কে উদাসীন থাকে, তাদের থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখা মানবীয় জীবনের কর্তব্য। (১৮: ২৮)
এই প্রেক্ষাপটে জামাআতের চতুর্বার্ষিকী পরিকল্পনায় চারটি মৌলিক বিষয় নিয়ে কিছু কথা পেশ করা হবে। এক) দাওয়াত, ২) ইসলাহ, ৩) তারবিয়াত ও ৪) খেদমত। কুরআন এ বিষয়ে আমাদেরকে পথ দেখায়? নবীগণের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে পথনির্দেশ দান করেন। কেননা, সৃষ্টির প্রথম নবী আদম (আ.) যখন জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেন তখন তার এবং তার সকল সন্তানদের লক্ষ্য করে আল্লাহ বলেছেন: যখন আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে হেদায়াত (নবী-রাসূলগণ) যাবে; যারা তা অনুসরণ করে চলবে; তারা পার্থিব এবং পরকালীন জীবনেও চিন্তিত ও ভীত হবে না’
আমরা ইসলামী জীবন দর্শনকে সামনে রাখলে এক লাখ ২৪ হাজার নবী এবং ৩১৩ অথবা ৩১৫ জন রাসূলের সংখ্যা জানতে পারি। কিন্তু কুরআন আমাদের সামনে দুই পর্যায়ে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছে। আমরা আমাদের বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে এই নবীগণের এবং সমাজের বাস্তব প্রেক্ষাপটে তাঁরা যে ভূমিকা পালন করেছেন- তা আমাদের চলার পথের পাথেয়। আমরা তাদের জীবনকে মূল্যায়ন করে আমাদের চলার পথের দিশা লাভ করব।
কুরআনে আদম থেকে ইয়াহিয়া পর্যন্ত ১৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হলেও তাদের বিস্তৃত বিবরণ আমাদের সামনে পেশ করা হয়নি। যেমন আদম, ইদ্রিস, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, ইলিয়াস, ইয়াসা’অ, দাউদ, সোলাইমান, আইয়ুব, ইউনুস, মুল কিফল্, যাকারিয়া ও ইয়াহ্য়্যা।
অপর দিকে দশজন নবীর জীবন বৃত্তান্ত ও সমকালের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গ সংঘাত, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নবীয়ানা কর্তব্য পালন করার ইতিহাস পেশ করা হয়েছে। এদের কার্যকলাপ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করাই আসল কাজ। এঁরা হলেন: নূহ, হূদ, সলেহ, শোআয়েব, ইব্রাহীম, লূত, মূসা, হারুন, ঈসা ও মুহাম্মদ (সা.)। আবার এদের মধ্যকার ৬ জনের সমকালে যুবসমাজ যেভাবে প্রতিকূলতার পাহাড় তৈরি করেছে এবং নবীগণকে মিথ্যা দোষারোপ করে তাদের বিরুদ্ধে অনবরত প্রচারণা চালিয়েছে, অতঃপর তাদের সমাজ আল্লাহর চূড়ান্ত শাস্তির কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এই ছয়টি জাতি হল (১) নূহ নবীর সমকালের সমাজ।(২) ফুল নবীর সময়ের আজ জাতি। (৩) সালেহর এর সময়ের ছায়েদ জাতি। (৪) শোআয়েব নবীর সময় জঙ্গলবাসী হিসাবে খ্যাত সমাজ। (৫) লূত নবীর সময়ের সমকামী জনগোষ্ঠী। এবং মূসা (আ.) এর সমকালে দুর্ধর্ষ ফেরাউনের – সখাত সলিল সমাধি প্রাপ্ত জাতি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানব সমাজের ইতিহাসে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য নবী-রাসূলগণের আগমন ঘটে এবং যারা তাঁদের প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করেছে, তাদের উৎখাত করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করেছে কিংবা তাদেরকে মৃত্যুর সম্মুখীন করেছে- পক্ষান্তরে তারা নিজেরাই চূড়ান্ত নিকৃষ্ট পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে।
আমাদের সামনে কুরআনের আলোয় নবীগণের দুই ধারার বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে। যারা তাদের জীবন দর্শনকে নিজেদের জন্য অনুকরণীয় করেছে, তারা হয়েছে সফল। কিন্তু যারা তা উপেক্ষা করেছে প্রকারান্তরে কুরআনের ভাষায় বলা যায় তারা তাদের জীবনের প্রকৃত মালিক আল্লাহকে ভুলে কিংবা আত্মভোলা হয়ে স্বেচ্ছাচারিতার জীবন-যাপন করেছে, তারা হয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত।
যে নবীগণ মানুষের আলোকিত জীবনের জন্য পথের দিশা পেশ করেছেন তারা কোন কোন বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন, সেগুলো আমাদেরকে চিহ্নিত করে পর্যালোচনা করতে হবে। আবার কী কী অপরাধের জন্য এক একটা জাতি ও সমাজ ভয়ংকর, মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন সয়েছে- তাও আলোচনায় আনতে হবে। অতঃপর আমরা সঠিক আলোর দিশা লাভ করতে সক্ষম হব।
তাহলে দেখা যাক, নবীগণ কোন পথের দিশা পেশ করেছেন? সকল নবী-রাসূলগণ প্রাথমিকভাবে নিম্ন মৌলিক বিষয়ে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। (১) এক ও একক নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহর একত্বের পরিচয়। (২) পিতৃপুরুষের অন্ধ অনুসরণ নয়। (৩) এই জীবনের শেষে পরকালের নিশ্চিত জীবন আছে। (৪) জীবনের সার্বিক মুক্তির জন্য নবী-রাসূলের পথ আঁকড়ে ধরতে হবে।
আমরা যেহেতু শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত বা অনুসারী- তাই কুরআন আমাদের পথের দিশা দেখাতে গিয়ে পূর্ববর্তী নবীদের আবেদনের সামঞ্জস্যতা ও বাস্তবতায় তাদের বিরোধিতার ধরন বোঝাতে গিয়ে তুলনামূলকভাবে আলোকপাত করেছে। তেমন নূহ নবী। দক্ষিণ ইরাকের মুসেল এলাকায় তাঁর আগমন ঘটে। ৯৫০ শত বছর দ্বীনের প্রচার করেছেনও। মুষ্টিমেয় ভিন্ন তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। তিনিই পৃথিবীর প্রথম রাসূল। আল্লাহ বলেছেন: ‘আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম- অতঃপর সে তাদের বললো- হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কেউ উপাস্য নেই। আর আমি- তোমাদের উপর এক কঠিন আযাবের দিনের আশংকা করছি।’ (৭: ৫৯) এমন একত্ববাদের কথা হূদ (আ.) জাতি আজ সমাজে বলেছেন (১১: ৫০; ২৩: ৩২); সামূদ জাতির কাছে সালেহ (আ.) বলেছেন (১১: ৬১) মাদায়েনের (জঙ্গলবাসী) মানুষের কাছে বলেছেন (৭: ৮৫; ১১: ৮৪)।
ঐ একই আবেদন হরযত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: ‘আমি তোমার আগে এমন কোন নবী পাঠাইনি, যার কাছে অহী পাঠিয়ে আমি এ কথা বলিনি যে, আমি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং তোমরা সবাই আমারই দাসত্ব করো। (২১: ২৫) এই কথার মধ্যে আছে আল্লাহর একত্বের ঘোষণা। এর বিপরীতে আছে শির্ক বা অংশীবাদ। আল্লাহ কস্মিনকালেও শিরকের সামান্যতম কথাকে গ্রহণ করেন না। আল্লাহ বলেন: ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ- যেখানে তার সাথে কাউকে শরিক করা হয়, আল্লাহ কখনো মাফ করেননি। এছাড়া অন্য সব পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করল, সে সত্যি আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করলো- যা বড় ধরনের একটি পাপ। (৪: ৪৮) অন্যত্র বলা হয়েছে: ‘শিরক সব চাইতে বড় যুলুম। (৩১: ১৩)
সকল নবীগণ মনুষ্য সমাজকে এক আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্য এবং তার বিপরীতে তার সঙ্গে কোন প্রকার অংশীদারিত্বের অবকাশ না রাখার জন্য বিভিন্নভাবে সতর্ক করে গেছেন।