আহমদুল ইসলাম চৌধুরী
মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন জাদুঘর হচ্ছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে অবস্থিত তোপকাপি মিউজিয়াম। যেহেতু এই জাদুঘরেই সংরক্ষিত আছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অতি মূল্যবান তবরুকাত। সঙ্গে মুসা (আ.)-এর আশ্চর্য লাঠি-সহ (আল্লাহর নির্দেশে যে লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানি দু‘ভাগ হয়ে রাস্তা তৈরি হয়েছিল, যে লাঠি মাটিতে রাখলে সাপ হয়ে যেত) আগের কয়েকজন নবী-রাসূলের ব্যবহৃত নানা মোবারক সামগ্রী এবং নবী পাক (সা.)-এর পরবর্তীকালে আহলে বাইত-সহ সাহাবা-তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনের ব্যবহৃত নানা দুর্লভ সামগ্রী এখানে সযত্নে সংরক্ষিত আছে। আরো আছে তুর্কি খিলাফত জামানার সুলতানদের নানা চোখ-ধাঁধানো দুর্লভ ঐতিহাসিক সামগ্রী।
তোপকাপি জাদুঘর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বসফরাস প্রণালির তীরে ইউরোপীয় অংশে প্রায় তিন দিকে প্রণালিবেষ্টিত এটি তুর্কি সুলতানদের বিখ্যাত সুরক্ষিত আলিশান রাজপ্রাসাদ তথা দুর্গ। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। মধ্যযুগীয় অপরূপ দৃষ্টিনন্দন নকশাখচিত তুর্কি স্থাপত্য কাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে বর্ধিত কলেবরে নির্মিত এ স্থাপত্য, যার আয়তন প্রায় ৭ লক্ষ বর্গমিটার। যেখানে সংরক্ষিত আছে মহানবী হযরত মোহাম্মদ স:-এর পানি খাওয়ার বাটি, দাঁড়ি, দাঁত, যুদ্ধে ব্যবহৃত তরবারী, তরবারীর খাপ, তীর ছোঁড়ার ধনুক। সেই সাথে হযরত দাউদ আ:-এর তরবারী।
উল্লেখ্য, পৃথিবীতে দাউদ আ: কে-ই আল্লাহ তায়াল প্রথম শিখিয়েছেন লোহার ব্যবহার। অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময় মিশর থেকে ইস্তানম্বুলে নিয়ে আসা হয় নবী ও খলিফাদের ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো।
তবরুকাতের প্রাসাদে একজন ক্কারী সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতরত থাকেন। তুর্কি সুলতানদের আমল থেকে পবিত্র তবরুকাতগুলোর সম্মানার্থে এখানে শত শত বছর ধরে কুরআন তিলাওয়াত চলছে। এখানে যেন ভিন্ন পরিবেশ; নুরানি ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মনে হবে। মন থেকে দোয়া-দরুদ চলে আসা স্বাভাবিক।
এখানে আয়নাঘেরা বাক্সের ভেতর নবী করিম (সা.)-এর চুল মোবারক/দাড়ি মোবারক, এক-দুই ফুটের ব্যবধানে ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হওয়া দান্দান মোবারক – সব কিছু এমনভাবে সংরক্ষিত আছে, যেন দর্শনার্থী অনায়াসে দেখতে পায়। কাছেই আছে ‘মোহরে নবুয়ত’। তার কাছে নবী করিম (সা.) কর্তৃক বিভিন্ন রাজার দরবারে প্রেরিত নানা গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্রের কপি, যার আকৃতি ১৬.১৯ সেমি, প্রায় ১২ লাইন বিশিষ্ট আরবিতে লিপিবদ্ধ চিঠি মোবারক।
এই ইসলামী ঐতিহ্যবাহী জাদুঘরে নবী করিম (সা.)-এর ৬০টি দাড়ি মোবারক সংরক্ষিত আছে। অন্যপাশে পাথরখণ্ডে নবী করিম (সা.)-এর পা মোবারকের চিহ্ন সংরক্ষিত আছে। আরেক পাশে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার নবী করিম (সা.)-এর মাথার বিশেষ টুপি ও বক্ষবন্ধনী সংরক্ষিত আছে। প্রাসাদের বৃহত্তর পরিসরের অপর পাশে নবী করিম (সা.)-এর ব্যবহার্য দুটি তলোয়ার সাজানো আছে। মহানবী (সা.) মোট ৯টি তলোয়ার ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়।
আরেক ব্লকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সুরক্ষিত আছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিত্য ব্যবহার্য বস্ত্র, পাগড়ি, লাঠি, পাদুকা যুগল ইত্যাদি মহামূল্যবান সামগ্রী। সব কিছুতে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে যথা—কোন স্থান থেকে কত সালে কীভাবে সংগৃহীত। দেয়ালের সঙ্গে উঁচু আয়নার ঘেরা বাক্সে অতি যত্নসহ মুসা (আ.)-এর লাঠি রাখা আছে। প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা আকৃতির আমাদের দেশীয় কাঠের রং প্রায় ২৫ এ.এম গোলাকৃতির উক্ত আশাতে ছয়-সাতটি গিরা (গিঁট) আছে। মুসা (আ.)-এর এই বিখ্যাত লাঠি মোবারকের অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা পবিত্র কুরআন মজীদের একাধিক স্থানে আছে।
নিকটস্থ আরেক ব্লকে নবী দাউদ (আ.)-এর ব্যবহৃত তলোয়ার ও চিঠি আছে। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও ওমর (রা.)-এর ব্যবহৃত তলোয়ার, ওসমান (রা.) এবং আলী (রা.)-এর ব্যবহৃত তলোয়ার, আরেক পাশে আছে খালেদ বিন ওলিদ (রা.), জাফর তৈয়ার (রা.), আমর বিন ইয়াসির (রা.)-এর ব্যবহার্য তলোয়ার।
প্রাসাদের অন্য বিশাল কক্ষজুড়ে আছে পবিত্র হাজরে আসওয়াদের ১৮৬১ সালের কভার, কাবা শরিফের ছাদের পানি পড়ার নালার (মিজারে রহমতের) সাবেক কাঠামো দুটি, একটি ১৬১২ অন্যটি ১৬৪০ সালের। স্বর্ণের পাত দ্বারা আবৃত নালাদ্বয়ের ওজন ১৪ কেজি করে। পবিত্র কাবাঘরের ছাদের পানি এই সোনালি নালা দিয়ে গড়িয়ে হাতিমের অভ্যন্তরে পড়ে থাকে, যার নাম মিজাবে রহমত।
পবিত্র কাবাগৃহের দরজা ১১৬০ সালের। অতঃপর আব্বাসীয় খেলাফত আমলের উক্ত দরজায় ব্যবহৃত কয়েকটি ডোর-লক এবং চাবি। যেগুলো খাঁটি সোনার তৈরি। কাবা শরিফের পুরাতন দরজায় ব্যবহৃত কাপড়ের কভার ১৮৫২ সালের। ওসমানীয় সুলতান কর্তৃক রওজাপাক ও মসজিদ-ই-নববীর নির্মাণকালীন মডেল ১৮৫২ সালের।