সুপ্রিম-ঠেলায় বদলাচ্ছে ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’ বলল বিরোধীরা

মীযান ডেস্ক: অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের গুঁতোয় পড়ে বদলাতে চলেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের বিতর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন। যা ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারা বলে পরিচিত। এর বদলে বেশকিছু সংযোজন করা হবে ১৫০ ধারায়। এর আওতায় দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা বা একতাকে বিপন্ন করে তোলার অপরাধে মামলা রুজু করা যাবে। শুক্রবার এই মর্মে লোকসভায় বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
উল্লেখ্য, সংবিধানের ১২৪(ক) ধারায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলতে এমন অপরাধ বোঝায়, যেখানে কেউ কথা, লেখা বা আচরণের মাধ্যমে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ালে, আইন অমান্য করলে বা হিংসায় উস্কানি দিলে বা করার চেষ্টা করলে, যা রাষ্ট্র বা আইন মেনে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে। তা হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা যায়। সম্প্রতি ব্রিটিশ জমানার এই আইন ঘিরে কম বিতর্ক হয়নি। এই আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সভা-সমাবেশ দমন করা, বিপ্লবীদের কাজকর্ম কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিকে শ্লথ করে দেওয়া। কিন্তু ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অভিযোগ এনে বিরোধী স্বর দমনের অভিযোগে বারেবারে বিদ্ধ হয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। বিতর্কিত আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে ২০২২ সালে মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টেও। আজ এহেন পরিস্থিতিতে বাদল অধিবেশনের শেষদিনে ১২৪(ক) ধারায় পরিবর্তন আনতে বিল পেশ করেন শাহ। বিলটিকে পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হয়েছে বলে খবর।
বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এই বিল হচ্ছে ‘গুয়ান্তানামো বে’ তৈরির প্রথম ধাপ। তর্কের খাতিরে ঔপনিবেশিক ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ আইন সরলেও তার জায়গায় যে ধারা আসছে তার প্রয়োগ অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। কোনও বিচার বা নাগরিক অধিকার ছাড়াই অভিযুক্তকে গারদে পোরা যেতে পারে।  জঙ্গি বা জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে যে কোনও অভিযুক্তেরই ন্যূনতম সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে পারবে তদন্তকারী সংস্থাগুলি।
উল্লেখ্য, সন্ত্রাস দমনের নামে কিউবায় রয়েছে আমেরিকার কুখ্যাত গুয়ান্তানামো-বে কারাগার। জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সেখানে নির্বিচারে সিআইএ-র থার্ড ডিগ্রির মুখে পড়েছে বহু নিরীহ মানুষ বলে অভিযোগ। এনিয়ে মার্কিন মুলুকেও কম জল ঘোলা হয়নি। শেষমেষ আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে একে একে বেশিরভাগ অভিযুক্তকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে আমেরিকা। কিন্তু বিনা অপরাধে কেবলমাত্র সন্দেহের বশে তাদেরকে গ্রেফতার করে সুদূর গুয়ান্তানামো কারাগারে বছরের পর বছর আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের জীবন থেকে যে বিরাট সময় শেষ করে দেওয়া হল, তার ক্ষতিপূরণ কী হবে? সে উত্তর কেউ দিতে পারেনি।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গত বছরের মে মাসে দেশের শীর্ষ আদালত কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছিল, যতদিন না ব্রিটিশ আমলের এই আইনের পর্যালোচনা শেষ করছে, ততদিন এই আইনে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। তারপরই নড়েচড়ে বসে মোদি সরকার। সুপ্রিম-ঠেলায় ব্রিটিশ জমানার রাষ্ট্রদ্রোহ আইন খোলনলচে বদলে আবার নতুন আঙ্গিকে চালু করতে সক্রিয় হল নরেন্দ্র মোদী সরকার।
প্রসঙ্গত, ১২৪ ধারা অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি নীতির বিরোধিতাও ‘রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য অপরাধ’ হিসাব গণ্য হতে পারে। ব্রিটিশ জমানার এই ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে শীর্ষ আদালত। গত বছর মে মাসে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি এন.ভি রমণার বেঞ্চ রায় দিয়েছিল, ‘যতদিন না কেন্দ্র সরকার ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন পুনর্বিবেচনা করছে, ততদিন স্থগিত থাকবে এই আইনের প্রয়োগ। কোনও রাজ্য সরকারের পুলিশও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা রুজু করতে পারবে না। সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি সেবার কেন্দ্র সরকারকে প্রশ্ন করেছিল, ৭৫ বছর পরেও স্বাধীন ভারতে কেন ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন চালু থাকবে? উল্লেখ্য, এই আইনেই মোদি সরকার বহু নিরপরাধ মুসলিমকে মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ সাজিয়ে এমন গুরুতর মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ভরে রেখেছে, যা নিয়ে আদালতও বহুবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তবে এবার নতুন যে আইন লাগু করতে চাইছে কেন্দ্র সরকার, সেটাকে নতুন বোতলে পুরনো মদ বলে কটাক্ষ করেছে বিরোধীরা।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: