মুদাসসির নিয়াজ
আজ ১৫ আগস্ট। মহান ভারতবর্ষের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস। ইতিহাসের পরম্পরায় এই দিনটি এক অনতিক্রম্য মাইলফলক। ১৯৪৭ সালের এই দিনেই তদানীন্তন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য, বঞ্চনা, শোষণ ও আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ-সংগ্রাম চূড়ান্ত সফল হয়েছিল। এদেশের মুক্তিকামী মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করে স্বাধিকার অর্জনের শপথ নিয়েছিলেন। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অগণিত তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে বহু আকাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট।
ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, আল্লাহ সকলকেই স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। একজন মানুষ হয়ে অন্য মানুষের নিকট পরাধীন থাকবে – এটাকে আল্লাহ-তাআলা আদৌ পছন্দ করেন না। সবাই নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে – এটাই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। প্রত্যেক মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীর মুখ দেখে। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এটাই স্বাভাবিক নিয়ম বা সুন্নাহ। আল্লাহ-তাআলা সবাইকে বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা দিয়েছেন। কাউকে পরাধীন করে তিনি ধরাধামে পাঠাননি। তাই মানুষ সহজাতভাবে এবং প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীনচেতা।
আল্লাহ তাআলা তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদা দিয়ে মানবজাতিকে অত্যন্ত সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করেছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সর্বোপরি আত্মিক পরাধীনতা ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। মাতৃভূমি রক্ষার্থে যারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে শহিদ হন, তাদের সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না।’ (সূরা বাকারা: ১৫৪)। কারণ, দেশের জন্য নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ প্রেম হৃদয়ে নিয়ে মজলুম জনতার দাবি আদায়ের স্বার্থে লড়াই করা আল্লাহর পথে লড়াই বা জিহাদেরই নামান্তর।
ইসলামে দেশপ্রেমের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। দেশপ্রেমকে বলা হয়েছে ঈমানের অন্যতম অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অর্থাৎ দেশকে ভালোবাসা ঈমানের পূর্বশর্ত। আর মুসলমানের প্রথম ধাপ বা শর্ত হল ঈমান। মাতৃভূমি, পিতৃভূমি বা জন্মভূমিকে ভালবাসা, দেশের মর্যাদা, সম্মান, গৌরব এবং সম্পদ রক্ষা ও এর যথাযথ ব্যবহার সুনিশ্চিত করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। একজন প্রকৃত মুসলিম বা মুমিন হিসেবে হৃদয়ে দেশের প্রতি নিঃশর্ত ভালবাসা লালন করা উচিত। যার হৃদয়ে দেশপ্রেম নেই, দেশ ও দেশের সম্পদ-সম্মান-মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, সে মুমিন ও মুত্তাকী হতে পারে না।
ইসলাম কেবল দেশপ্রেমকে ঈমানের অঙ্গ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি; আরো একধাপ এগিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে ভালবেসে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে জীবনদানকারী মানুষকে শহীদের মর্যাদা দান করেছে ইসলাম। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, একদিন এক রাতের দেশ-প্রহরা ক্রমাগত এক মাসের নফল রোযা এবং সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়া অপেক্ষাও উত্তম (মুসলিম)।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন একজন আদর্শ ও প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষ। দেশের প্রতি ভালবাসা, দেশকে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেওয়া, দেশ ও দেশবাসীকে সম্মান করা সহ দেশাত্ববোধক এমন কোনো ভাল গুণ নেই, বিশ্বনবীর (সা.) মাঝে যার সম্মিলন ঘটেনি। দেশকে ভালবেসে হিজরত করেছেন, কিন্তু যাদের জন্য তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করেননি। দেশাত্ববোধ ও দেশপ্রেমের এমন উজ্জ্বল উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। তাই তাঁকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক এবং বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী।
স্বাধীনতা একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রথম অধিকার। ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সব ধরনের স্বাধীনতাকে ইসলাম যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সারা জীবনের মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্যতম ছিল মজলুম জনতাকে স্বাধীনতা পাইয়ে দেওয়া এবং প্রভুর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। পৃথিবীতে যখন যেখানে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা বা অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে, মানুষ তার নিজস্বতা-স্বতন্ত্রতা হারিয়েছে, সেখানেই উচ্চারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবতার দাবি। কালের পরিক্রমায় মহান আল্লাহ সেখানেই মজলুম মানবতার আকুতিকে মান্যতা দিয়ে জালেমের অবসান ঘটিয়েছেন।
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকার-বঞ্চিত পরাধীন মানুষের জন্য মানবতাবাদ আর স্বাধীনতার বাণী নিয়ে জাহেলিয়াতের যুগে আগমন ঘটেছিল সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর। আরবের মানুষ যখন পরাধীনতার আন্ধকার যুগের অধিবাসী, বিশ্বনবী (সা.) তখন এসেছিলেন স্বাধীনতা আদায়ের বাণী নিয়ে। মানুষকে স্বাধীন করে প্রভুর সঙ্গে সেতুবন্ধন করতে এসেছিলেন তিনি। সর্বোপরি মানবতার মুক্তির দাবিই ছিল প্রত্যেক নবী-রাসূলের আগমনের প্রথম ও প্রধান কারণ এবং তারা জানতেন-বুঝতেন, পরাধীনতা প্রভুর সান্নিধ্য অর্জন বা নৈকট্য লাভের অন্তরায়। ইসলাম স্বাধীনতা অর্জন করা এবং পরাধীনতা থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্বারোপ করেছে।
স্বাধীনতার মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, মৃত ব্যক্তির সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তার আমল আর বৃদ্ধি পেতে পারে না। তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার আমল কেয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং কবরের প্রশ্নোত্তর থেকেও সে মুক্ত থাকবে। (তিরমিজি, আবু দাউদ)।
স্বাধীনতার মতো বিশেষ এই নিয়ামতকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করা উচিত আমাদের। স্বাধীনতার অর্জন যাতে কোনোভাবেই ম্লান না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ নিয়ামত। সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ-তাআলা আমাদের সকলকে স্বাধীনতার প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে দেশকে মনেপ্রাণে ভালবাসার তাওফীক দান করুন, আমীন।