ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরলতম ঘটনা হিসেবে আজও অম্লান হয়ে রয়েছে। তিনি সপরিবারে শাহাদত বরণ করেন। অবশ্য তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য বেঁচে যান। যারা জীবিত ছিলেন, তারা ইসলামের ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মুহাদ্দিস, ফকিহ ও তাফসীর শাস্ত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছেন। ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত বরণ ইসলামের পুর্নজাগরণে এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে। তিনি কী কারণে এতবড় ঝুঁকি নিয়ে ইয়াজিদ বাহিনীর মুখোমুখি হলেন সত্যিই তাই প্রণিধানযোগ্য। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর মুখোমুখি হন। ইয়াজিদ ইসলামী গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে ছাড়েন। তাঁর পিতা হযরত মুয়াবিয়া (রা.) খিলাফতী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বদলে রাজতান্ত্রিকতা শুরু করে দেন। যদি হযরত মুয়াবিয়া (রা.) রাজ্যপাল হিসেবে হযরত আলী (রা.)-র কেন্দ্রীয় সরকারকে মেনে নিতেন এবং তার আনুগত্য প্রকাশ করে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতেন তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে যেত। এত রক্তপাত মুসলিমদের মধ্যে ঘটত না। হযরত উসমান গণি (রা.)-এর হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি হযরত মুয়াবিয়ার ঠিক হলেও, কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল এই বিষয়ে। হযরত আলী (রা.) তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেননি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হতে চেয়েছিলেন। কেননা, মদিনার পরিস্থিতি খুবই জটিল ছিল। যাহোক, দ্বন্দ্বের পরিণতিতে জঙ্গে জামাল, জঙ্গে সিফফিন ও নাহরওয়ানের যুদ্ধ ঘটে গেল। শিয়া ও সুন্নি মতধারার উদ্ভব হয়েছে এর পরিণামে। কট্টরপন্থী বাতিল ফিরকারও উদ্ভব হয়। খারেজী উপদল গড়ে তোলা হয়। এরা হযরত আলীর জানের খাতরা হয়েছিল। তিনি শহীদ হয়ে গেলেন।
আজও কট্টরপন্থী গ্রুপগুলো আছে। এদের কেউ কেউ তাকফিরি চিন্তায় বিশ্বাসী। এই কট্টরপন্থীদেরকে আজকের দুনিয়ায় ইসলামের দুশমনরা নিয়মতান্ত্রিক পথে যারা আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়। ইমাম হুসাইন (রা.) ছিলেন নবী করিম (সা.)-এর দৌহিত্র। ‘শেরে খোদা’ হযরত আলি (রা.)-র পুত্র। তাঁর রুধির ধারায় জ্ঞান, তাকওয়া, যুহদ, খোদাপ্রেম, দ্বীনের তত্ত্বজ্ঞান এবং জেহাদি প্রেরণা প্রবহমান। যা নবী করিম (সা.)-এর নবুয়তী মিশন থেকে প্রাপ্ত হয়েছে।
ইমাম হুসাইন (রা.) কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শহিদ হয়েছেন, তাও সপরিবারে। কোন নবী পরিবারের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। কি করে আল্লাহর রাসূলের পরিবারের সদস্যদের এমন এক নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করা হল তা হৃদয়ে আঘাত লাগারই কথা! সেজন্য উম্মতে মুহাম্মদী আজো কারবালার ইতিহাসকে ভুলতে পারেনি। ইমাম হুসাইন (রা.)-কে অনেক মর্যাদাশালী সাহাবাগণ কুফা যেতে মানা করেছিলেন। কেননা, তাঁরা জানতেন যে, তাঁর পিতা হযরত আলি (রা.)-কে কুফাবাসীরা সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ঠিক এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল ইমাম হুসাইন (রা.)-র জীবনে। তিনি তো মুসাফির হিসেবে ওখানে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন কুফাবাসীদের ডাকে। তিনি ক্রন্দন করতে যাননি। বরং তাঁকে কাঁদানো হয়েছে। আল্লামা ইকবাল এক মর্সিয়া-য় অনবদ্যভাবে এই কথাগুলিকে তুলে ধরেছেন। এবং নিজে তা গেয়েছেন।
ইমাম হুসাইন (রা.)-এর জিহাদে শরীক হওয়া নিয়ে বিতর্ক করার কোন উপায় নেই। তিনি বিদআতের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলেন। আর সেই বিদআত ছোটখাটো বিদআত নয়। ইবাদতের ক্ষেত্রে যে যে বিদআত হয়েছে, এই বিদাআত তথা নব উদ্ভাবিত পন্থাটি দ্বীনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মূলে আঘাত করা হয়েছে। তা হল কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে খিলাফত তথা ইসলামী গণতান্ত্রিকতায় যে অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন রাষ্ট্রীয় চেতনা গড়া হয়েছিল, তার মূলে আঘাত আনা হয়। ফলে উমাইয়া ও আব্বাসীয় রাজতান্ত্রিকতা শুরু হয়। এই রাজতন্ত্র ইসলামের খিদমত অনেক করলেও যে খারাবীগুলোর উৎপত্তি ঘটিয়েছে, তার ফলে দ্বীন-ইসলামের অনেক ক্ষতি সাধন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল যে, রাজনীতি ও ধর্ম পৃথক – এটা আস্তে আস্তে মুসলমানদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন নাসারারা এই চিন্তার উদ্ভব অনেক আগেই ঘটিয়েছিল। মুসলিম দুনিয়ায় উপদলীয় কোন্দল ব্যাপক হারে শুরু হয় খিলাফত ধ্বংস হওয়ার পর। ফিরকা ও মাযহাবী কোন্দল শুরু হয়। খিলাফত ব্যবস্থা টিকে থাকলে এমনটা হত না। যেমন হযরত আবুবকর ও উমর ফারুকের জামানায় হতে পারেনি। কেননা, মুসলমানদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবন একই কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হত।
তৃতীয়ত: মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিলাসিতা, আরামপ্রিয়তা, অনৈতিকতার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। জনগণের মালকে তারা আত্মসাৎ করতে থাকে। বাইতুল মালে হস্তক্ষেপ হতে থাকে।
চতুর্থত: সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহীর সম্মুখীন হওয়ার বাধ্য-বাধকতা মুক্ত হয়ে যায়। হযরত উমর ফারুক (রা.)-কে একজন সাধারণ নাগরিক, একজন বৃদ্ধা জবাবদিহী করতে বাধ্য করেন। তা সম্পূর্ণ উঠে যায়।
পঞ্চমত: বিজাতীয় সংস্কৃতি মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। দ্বীনের মধ্যে অন্যান্য ধর্মীয় দর্শন ও চিন্তাধারা অনুপ্রবেশ করে। বৈরাগ্যবাদী চিন্তা, সুফি মতবাদ তারই প্রতিফলন। মুতাযিলা মতবাদ গড়ে ওঠে আব্বাসীয় শাসনামলে। এরা ছিল যুক্তিবাদী। কুরআনকে আল্লাহর চিরন্তন বাণী না বলে একে ‘আল্লাহর সৃষ্টি’ বা ‘খালকে কুরআন’ বলে প্রচার করতে থাকে। একে মেনে নেওয়ার অর্থ হল তাহরিফ বা পরিবর্তন করার মান্যতা পেয়ে যাওয়া। কিন্তু ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রা.)-এর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ও যুক্তির কাছে মুতাযিলা গোষ্ঠী পরাভূত হয়।
শেষ কথা হল ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কারবালা প্রান্তরে শহিদ হওয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামের পুনর্জাগরণ যুগে যুগে হয়েছে এবং হতে থাকবে। তার মহান ত্যাগ, কুরবানী চির অম্লান হয়ে থাকবে। সব যুগে উম্মতকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে যাবে কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা।