হামাস, শিয়া ও সুন্নি

ডা. মসিহুর রহমান

হামাস কি সন্ত্রাসী সংগঠন? এককথায় আদৌ হামাস সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। ইজরায়েল হামাসকে সন্ত্রাসী, জঙ্গী সংগঠন বলে সারা দুনিয়ায় প্রচারের চেষ্টা যতই করুক না কেন, তাতে কল্কে পাবে না। আমেরিকা ও তার মিত্ররা হামাসকে সন্ত্রাসী বললে তাতে কিছু যায় আসে না। কে সন্ত্রাসী আর কে সন্ত্রাসী নয় – তা ফারাক করার মতো বোধ-বুদ্ধি মানুষের লোপ পেয়ে যায়নি। ইজরায়েলী সরকারের ফিলিস্তিনবাসীদের উপর বর্বরোচিত হামলাকে কেন নাৎসী-ফ্যাসিবাদী চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে না – সে বিষয়ে প্রশ্ন মানুষ তুলেছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভদ্রভাষায় ইজরায়েলের কুৎসিত চরিত্রের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হিটলার ইহুদীদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন, ইজরায়েল সেই একই কুকর্ম ফিলিস্তিনের ওপর করছে। পুতিনের এই কথায় ইজরায়েলের ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসী চরিত্রকে বেআব্রু বিশ্ববাসীর সামনে করে দিয়েছেন। পুতিনের এই কথাকে সমর্থন না করে পারা যায় কি?

হামাস হল ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে প্রতিরোধকামী বিপ্লবী শক্তি। দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে সাম্রাজ্যবাদী, দখলদার বাহিনীকে উৎখাত করার জন্য দখলকৃত দেশের বীর বিপ্লবীরা তথা মুজাহিদরা লড়াই করেছেন। তারা হলেন দেশপ্রেমী। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সেই বীরদেরকে ইংরেজ সরকার সন্ত্রাসী বলে তাদের জেল, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মেরেছে। কিন্তু তাঁরা আজও দেশবাসীর কাছে বিপ্লবী ও দেশপ্রেমী। শুধু ভারতই নয়, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কবলে যে দেশসমূহ অতীতে পড়েছে, সেই সব দেশের সংগ্রামী মানুষদের দল, বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশকে পরাধীনতার লাগাম থেকে উদ্ধার করার জন্য। তারা যুদ্ধ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী দালালরা তাদের সন্ত্রাসী বললে তাতে ইতিহাস বদলে যায় না।

ফিলিস্তিনের কত লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইজরায়েলী যায়নবাদীরা হত্যা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। হাজার-হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস করেছে। ফিলিস্তিনবাসীদের ঘর-বাড়ি দখল করে ইহুদীদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের জমি-জমা জোর করে দখল করে ইহুদীদের বসানো হয়েছে। গাজাকে “উন্মুক্ত জেলখানা” বানানো হয়েছে। ৪১ কিমি. লম্বা ও ৫-৬ কিমি. চওড়া এই ছোট্ট জায়গায় ২১ লাখ মুসলমানরা অবর্ণনীয় দুঃখ, কষ্ট, যাতনা নিয়ে বাস করে। গাজার একদিকে ভূমধ্যসাগর, আর দু’দিকে ইজরায়েল। ছোট্ট একটি জায়গা রয়েছে, যা রাফাহ নামে পরিচিত। এই জায়গাটি থেকে মিশরে কোন গাজাবাসী ঢুকতে না পারে তার জন্য বন্ধ করে রেখেছে মিশর সরকার।

গাজাকে যে কোন মুহূর্তে একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারে। এই গাজা উপত্যকায় পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও মেডিসিন সরবরাহ সবই যায়নবাদী ইজরায়েল সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। হামাস গাজাবাসী তথা ফিলিস্তিনের জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতীক। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াই জারি রাখার ঈমানী দায়িত্ব মুসলিম দেশগুলির। বিশেষ করে আরব দেশগুলির ওপর বিশেষ দায়িত্ব পড়ে। শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনবাসীদের রক্ষায়, তাদের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার বিষয়ে বিশ্ব মুসলিম সমাজের এক হওয়া দ্বীনি ও ঈমানী দায়িত্ব। মসজিদুল আকসার পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব মুসলিমদের। ইজরায়েলের দখলদারি নীতির বিরুদ্ধে বৈধ পন্থায় মুসলিম দেশগুলির একযোগে ব্যবস্থা নেওয়া কর্তব্য বিশেষ। যায়নবাদী ইজরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্ন তখনই ভাবা যাবে, যখন ইজরায়েল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবে। নচেৎ ইজরায়েলের মুরুব্বীর কথায় নতজানু হয়ে বা নিজেদের রাজতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী শাসন ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে বা “আরব বসন্ত”-এর ভয়ে ইজরায়েলকে স্বীকৃতি যদি আরব বা অনারব মুসলিম দেশগুলির সরকার দেয়, ওইসব দেশের মুসলিম জনগণ তা মেনে নেবে না। এমনকি গণতন্ত্রপ্রিয় বিশ্ব সমাজও মানবে না। মানা উচিৎও নয়। কেননা, এটা হবে ইনসাফের সম্পূর্ণ বরখেলাপ। আর ইসলাম তো সবার জন্য ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছে। তা সে যে ধর্মেরই মানুষ হোক না কেন।

সৌদি আরব ও ইজরায়েলের মধ্যে আলোচনা চলছিল হামাসের আক্রমণ হওয়ার ঠিক আগে। মাঝখানে জো বাইডেনের সরকার মধ্যস্থতায় ছিল।
Strike, when iron is hot – এই প্রবাদবাক্য অনুসারে কাজ করেছে হামাস। হামাসের আক্রমণ ছাড়া গাজা তথা ফিলিস্তিনকে টিকিয়ে রাখা যেত না। মসজিদুল আকসাকে ধবংস করে ছাড়ত। গাজাবাসীদের উৎখাত করে ছুড়ে ফেলে দিত যদি সৌদির স্বীকৃতি ইজরায়েল পেয়ে যেত। ইজরায়েল শুধু সৌদির নয়, তলে তলে পাকিস্তান, বাংলাদেশকেও হাতে পাবার চেষ্টা করছে। তুরস্ক তেমন কিছু করতে পারবে না, কেননা তার সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ইজরায়েলের। মিশরের অবস্থাও তাই। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি সেরে রেখেছে ইজরায়েল। সিরিয়া দুর্বল, নিজে থেকেই নিজেকে দুর্বল করেছে। সরকার ও সরকার-বিরোধীদের লড়াইয়ে সিরিয়া নাস্তানাবুদ হয়ে রয়েছে। পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। কিন্তু তার অভ্যন্তরীন অবস্থা ভাল নয়। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল।

পাকিস্তান, মিশর, সৌদি, তুরস্ক, সিরিয়া – সবার এই হেন অবস্থাতেও হামাস ইজরায়েলের মতো শক্তিধর দেশকে বোকা বানিয়ে দিল। তার দুর্ধর্ষ গোয়েন্দাবাহিনী মোসাদ ব্যর্থ। সীমান্তে রাডারকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ল হামাস বাহিনী। যে ইজরায়েল দুনিয়াকে অস্ত্র বিক্রি করে, গোয়েন্দা তৎপরতাকে অন্যদের শেখায় বা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে – সবকে ব্যর্থ করে দিল। হামাসের ঈমানী যজবাকে দেখে অভিভূত হতে হয়। তবে মনে রাখতে হবে হামাসকেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার কৌশল রপ্ত করতে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। আজকের যুগে খালিদ বিন ওয়ালিদ-এর মতো সেনাপতিকেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করে শত্রুর মোকাবিলা করতে পারা যাবে না। খালিদ বিন ওয়ালিদ রোমান সেনাপতির তলোয়ারের মোকাবিলায় তলোয়ার চালিয়েছিলেন। কবেই সেই যুগ অতীত হয়ে গেছে।

হামাস আহলে হাদীস-সালাফী মতধারাকে মেনে চলে। হামাস সুন্নি। সেই দিক দিয়ে কিন্তু আহলে হাদীস মতধারাকে মেনে চললেও শিয়া ইরান ও শিয়াপন্থী হিজবুল্লাহ তাদের পাশে শক্তভাবে অবস্থান নিয়েছে। আয়াতুল্লাহ খোমেইনি ইসলামী বিপ্লবের সেই দিনগুলিতে স্লোগান তুলেছিলেন – লা শিয়া, লা সুন্নি নাহনু মুসলেমুন। অর্থাৎ আমরা শিয়া নয়, সুন্নি নই, আমরা মুসলিম। লা শারকিয়া, লা গারবিয়া-ইসলামিয়া, ইসলামিয়া। প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্য নয়, ইসলাম, ইসলাম।

ইরান এই সময়ে হামাসের পক্ষে যদি না দাঁড়াত তাহলে হামাসের জন্য পরিস্থিতি আরও আরও কঠিন হয়ে যেত। দুর্দিনের সাথী ইরান। যাদেরকে সুন্নি দুনিয়া শিয়া শিয়া বলে চিল চিৎকার করে থাকে, সেই ইরানের কূটনীতিতেই চীন ও রাশিয়া ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। এ কি কম বড় সাহায্য। যদি ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ লেবানন সীমান্ত থেকে রকেট লঞ্চিং না করত, তাহলে ইজরায়েল আরও বেপরোয়া হয়ে যেত। ইয়েমেনের শিয়া হুথিরাও তৈরি ফিলিস্তিন ও মসজিদুল আকসা রক্ষার জন্য। ফিলিস্তিন হল নবী-রাসূলদের পুণ্যভূমি। অসংখ্য নবী-রাসূল এখানে দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করেছেন। ইব্রাহীম (আ.) মক্কায় মা হাজেরা ও কোলের শিশু ইসমাঈল (আ.)-কে রেখে এই ভূমিতেই আসেন দ্বীন প্রচারের জন্য।

আজ তথাকথিত সুন্নি রাষ্ট্রগুলো কি তাদের দায়িত্ব পালন করছে। তারা কি তাদের দ্বীনি, আখলাকি, এমনকি মানবিক দায়িত্ব পালন করতে সমর্থ হচ্ছে? আরব রাষ্ট্রগুলোতে যতদিন রাজতন্ত্র তথা মুলুকিয়াত থাকবে, ততদিন ইসলামের সোনালী দিন আসতে ব্যাহত হবে। যদি কমপক্ষে আরব দুনিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকারগুলো থাকত, তাহলে ফিলিস্তিনের সপক্ষে কার্যকর পদক্ষেপ তারা নিতে পারত। জনগণ যা চাইছে, এইসব সরকারগুলো তা চাইছে না নিজেদের গদি রক্ষার্থে। আরব দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র তো দূরের কথা, গণতান্ত্রিক সরকার আসুক, তা সাম্রাজ্যবাদীরা চাইবে না। অতীতেও চায়নি। এটা তাদের কৌশল।

যাহোক, ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে শিয়া ও সুন্নি বিভাজন কমবে। ইহুদীবাদীদের মসিহ দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছে। এই লড়াইয়ে একদিন শিয়া-সুন্নি বলে কিছুই থাকবে না। ইমাম মাহদীর পতাকাতলে শিয়া-সুন্নির বিভক্তি মুছে যাবে ইনশাআল্লাহ। আর যারা ফিরকার ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে রেখেছে, তাদের মতিভ্রমে সেদিন মুসলিমরা প্রভাবিত হবে না। দেওবন্দি, বেরেলি, আহলে হাদীস – ফিরকার ভিত্তিতে পরিচয় থাকবে না। বাগদাদ শরীফ, বেরেলি শরীফ, আজমীর শরীফ, নকশবন্দিয়া, চিস্তিয়া, কাদেরিয়া – এসবেরও অবসান হবে ইমাম মাহদী ও হযরত ঈশা ইবনে মরিয়ামের আগমনে। সেদিন নিকটেই। অবশ্য আল্লাহই ভালো জানেন সেই সময়ের বিষয়টি।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: