মীযান ডেস্ক: হিজবুল্লাহ সুপ্রিমো সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহর জন্ম ১৯৬০ সালে। অর্থাৎ এখন তাঁর বয়স ৬৪ বছর। বড় হয়েছেন রাজধানী শহর বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের বুর্জ হামদ এলাকায়। আব্বা আবদুল করিম ছিলেন সবজি বিক্রেতা। ৯ সন্তানের মধ্যে নাসরুল্লাহ সবার বড়।
১৯৭৫ সালে লেবানন গৃহযুদ্ধের মুখে পড়লে হাসান নাসরুল্লাহ শিয়া মুভমেন্ট ‘আমাল’-এ যোগ দেন। ১৯৮২ সালে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে দল ছেড়ে বেরিয়ে যান। ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় ‘ইসলামিক আমাল’ নামে নতুন সংগঠন। পরবর্তীতে নাম বদলে হয় হিজবুল্লাহ। শুরু থেকেই তাতে রয়েছেন হাসান নাসরুল্লাহ। হিজবুল্লাহ প্রথম থেকেই আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘ইসলামের প্রধান শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই সঙ্গে ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের অবৈধ দেশ হিসেবে ঘোষণা করে ইহুদিদের অবৈধ দেশটিকে মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার শপথ নেয়।
১৯৯২ সালে ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান নির্বাচিত হন নাসরুল্লাহ। এর আগে ইসরায়েলের এক হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হন তাঁর পূর্বসূরি আব্বাস আল মুসাবি। হিজবুল্লাহ প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর মুসাবি হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া ছিল হাসান নাসরুল্লাহর প্রথম কাজ। সে অনুযায়ী ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার নির্দেশ দেন তিনি। পাশাপাশি তুরস্কে ইসরায়েলের দূতাবাসে গাড়িবোমা হামলায় এক ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও আর্জেন্টিনায় ইসরায়েলি দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলায় ২৯ জন নিহত হন।
নাসরুল্লাহ লেবাননের দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গেও তাঁর যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। হিজবুল্লাহর কাছে পেরে না উঠে ২০০০ সালে পিছু হটে দেশে ফিরে যায় ইসরায়েলি সেনারা। তবে নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে শহিদ হয় তাঁর বড় ছেলে হাসান হাদি।
দখলকৃত লেবানিজ ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনাদের তাড়াতে মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে উঠেছিল হিজবুল্লাহ। পরে এ দলকেই শক্তিশালী এক বাহিনীতে রূপ দেন নাসরুল্লাহ। সংগঠনটি এখন দেশের রাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তারকারী একটি শক্তি।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর থেকে হিজবুল্লাহ বনাম ইসরায়েল উত্তেজনা বেড়ে যায়। আগের দিন ৭ তারিখ ইসরাইলে রকেট হামলা চালায় হামাস। পরদিন প্রতিশোধ নিতে গাজা উপত্যকায় নজিরবিহীন হামলা শুরু করে ইসরাইল। ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে মাঝেমধ্যেই ইসরায়েলে রকেট হামলা চালাতে শুরু করে হিজবুল্লাহ।
লেবাননের শিয়া মুসলিম সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম পরিচিত ও সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের একজন। সম্প্রতি লেবাননে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শুক্রবার রাজধানী বৈরুতে হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টারকে নিশানা করে রাতভর বিমান হামলা চালায় ইহুদি সেনারা। যদিও প্রাণনাশের আশঙ্কায় কয়েক বছর ধরেই জনসম্মুখে আসছেন না নাসরুল্লাহ। তারপরেও ইসরাইলের কুখ্যাত গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ দাবি করেছে, তারা অনেককাল ধরেই জাল বিছিয়ে রেখেছিল। তাতেই জানা যায়, নাসরুল্লাহর অজ্ঞাতবাসের ঠিকানা।
হিজবুল্লাহকে লেবানন তথা মধ্যপ্রাচ্যের এক অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি ও বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অরাষ্ট্রীয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনে হাসান নাসরুল্লাহর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ইসরায়েলের ছায়াশত্রু নাসরুল্লাহ বছরের পর বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও তাঁর প্রতি সমর্থকদের শ্রদ্ধা-ভালবাসা এতটুকু কমেনি।
হিজবুল্লাহ শুধু রাজনীতি বা সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হওয়ার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে লেবাননের জনগণকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, নানাবিধ মানবকল্যাণ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত। ‘ওপেন লেটার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনার মধ্য দিয়ে ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথা জানায় হিজবুল্লাহ। সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হিজবুল্লাহতে নাসরুল্লাহর অবস্থান মজবুত হতে থাকে, বাড়তে থাকে দায়িত্ব।
২০০৬ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর মধ্যে পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত ছিল। তবে ওই বছর হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরায়েল সীমান্তে হামলা চালালে আট সেনা নিহত ও দুজন অপহৃত হন। পরে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে যুদ্ধবিমান থেকে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহও প্রায় চার হাজার রকেট ছুড়ে জবাব দেয়। ৩৪ দিন ধরে চলা ওই লড়াইয়ে অন্তত ১১২৫ লেবানিজ শহিদ হন, যাঁদের বেশিরভাগ ছিল বেসামরিক লোক। নিহত হন ১১৯ ইসরায়েলি সেনা ও ইসরায়েলের ৪৫ বেসামরিক নাগরিকও। লড়াই চলাকালে ইসরায়েল নাসরুল্লাহর বাড়ি ও অফিসে যুদ্ধবিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে। তবে তিনি অন্যত্র থাকায় সে যাত্রায় বেঁচে যান।
এই পর্যায়ে হিজবুল্লাহ আট হাজারেরও বেশি রকেট হামলা এবং ইসরায়েলি যুদ্ধযানগুলোকে ধ্বংস করতে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোন দিয়েও আক্রমণ চালায় বিভিন্ন ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনায়। বিপরীতে লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলার পাশাপাশি ট্যাংক, গোলা নিক্ষেপ ও গোলন্দাজ ইউনিট ব্যবহার করছে ইসরায়েল।
গত সপ্তাহে লেবাননে পরপর দুদিন কয়েক হাজার পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে হিজবুল্লাহর কয়েকজন সদস্য-সহ অন্তত ৪৯ জন নিহত এবং হাজার খানেক মানুষ আহত হন। এর জন্য ইসরাইলকে কাঠগড়ায় তুলে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, ‘ইসরায়েল সব সীমা লঙ্ঘন করে কাপুরুষোচিত হামলা করেছে, আগুন নিয়ে খেলছে এবার।’ শেষ খবরে জানা গিয়েছে, গত দু-সপ্তাহে লেবাননে ইসরাইলি হামলায় সব মিলিয়ে প্রায় ৮০০ প্রাণহানি হয়েছে।