ইসরাইল: পৈশাচিকতার সর্বোচ্চ নিদর্শন

বিশেষ প্রতিবেদন

যায়নবাদী ইহুদিরা ফিলিস্তিনের বুকে তাদের বসতি স্থাপনের সূচনাকাল থেকেই স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন, জোর-যুলুম, লুণ্ঠন, হত্যা ও উচ্ছেদ তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এটা জোরের সাথেই বলা যায় যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে ‘জাতি’ হিসেবে অন্য কোন জাতিই এহেন পৈশাচিকতার আশ্রয় গ্রহণ করেনি। যায়নবাদী ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মাটিতে প্রথম সন্ত্রাসবাদী অভিযান চালায় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় ইউরোপ থেকে আগত যায়নবাদী সস্ত্রাসীরা ফিলিস্তিনের ‘উয়ূন্ কারেহ, মালবাস ও জামারিন্ নামক তিনটি অঞ্চলের ওপর হামলা চালিয়ে বহু মূলনিবাসী ফিলিস্তিনিকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং বাকিদেরকে বিতাড়িত করে এলাকাগুলো দখল করে নেয়। তখন থেকে শুরু করে তারা অসংখ্য পৈশাচিক অপরাধ সংঘটিত করেছে; হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করেছে, তাদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে, বাড়িঘর-জমিজমা দখল করেছে। যায়নবাদীদের পৈশাচিকতা ও সন্ত্রাসী ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলেছে।

ইসরাইল প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বে যায়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে তা হচ্ছে দীর ইয়াসীন অঞ্চলে হাড়হিম করা হত্যাকাণ্ড। ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল মেনাহেম বেগিন ও আইযাক শামীরের নেতৃত্বে ১৩০ জন যায়নবাদী সন্ত্রাসী পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসের অদূরে পার্বত্যপল্লী দীর ইয়াসীনের নিরীহ ফিলিস্তিনীদের ওপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে। তারা গ্রামটির চারশ’ অধিবাসীর মধ্যে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে অন্তত ২৫০ জনকে হত্যা করে। তাদের পৈশাচিকতা শুধু হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তারা হত্যার জন্য অত্যন্ত বীভৎস পন্থা অবলম্বন করে। তারা আনেকের হত-পা, পেট ও কান কেটে ফেলে, চোখ তুলে নেয়, মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে, নারীদের উদর কর্তন করে, মায়ের কোলে সন্তানকে হত্যা করে, অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। এছাড়া কতক ফিলিস্তিনী তরুণীকে নগ্ন করে ট্রাকে তুলে বায়তুল মুকাদ্দাসের ইহুদি অধ্যুষিত এলাকায় নিয়ে গিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় প্রদর্শনী করে এবং ঐ অবস্থায় তাদের ছবি তুলে রাখে।

দীর ইয়াসীনের এই গণহত্যা এবং এতে অবলম্বিত পৈশাচিক প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদেরকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা এবং যায়নবাদীরা এতে পুরোপুরি সফল হয়েছিল। ইসরাইল রাষ্ট্রে আত্মপ্রকাশের পর সংঘটিত প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে) জর্দানি বাহিনী আল্লাদ্ ও রামাল্লাহ ছেড়ে চলে যাবার পর ইহুদিরা এই দু’টি শহরে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়; তারা শিশু, বৃদ্ধ ও নারীসহ শত শত লোককে হত্যা করে। ফলে এখানকার অনেক অধিবাসীই বাস্তুহারা হয়ে যায় এবং আরব নিয়ন্ত্রণাধীন অন্যান্য ফিলিস্তিনি এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।

ইসরাইলের দ্বারা অবাধে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী তৎপরতার আরেকটি বীভৎস দৃষ্টান্ত হচ্ছে কাবীয়াহ্ পল্লিতে পরিচালিত গণহত্যা। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর সকালে একদল ইসরাইলি সৈন্য উক্ত গ্রামে হামলা চালিয়ে ৭০ জনকে হত্যা করে এবং গ্রামটির অর্ধেক ধ্বংসস্তপে পরিণত করে। কিন্তু আরবদের অভিযোগের জবাবে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসরাইলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে সামান্য তিরস্কার করে মাত্র। ফলে নাহালীন্ ও বাদ্রাসে ইসরাইল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে।

যায়নবাদীদের এহেন বর্বরতা, নারকীয়তা ও পৈশাচিকতা শুধু অধিকৃত ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; ১৯৮২ সালে তারা যখন লেবানন দখল করে তখন ২৫ হাজার লোককে হত্যা করে, ২ লাখ ৮০ হাজার জনকে আহত করে এবং ২ হাজার কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ ধ্বংস করে। এ সময় তারা লেবাননে ১৬ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে বন্দি করে এবং এর ফলে ঐ সময় পর্যন্ত কারাগারে নিক্ষিপ্ত ফিলিস্তিনির সংখ্যা আড়াই লাখে দাঁড়ায়। তারা ১২ হাজার লেবাননিজ ও ফিলিস্তিনি বন্দিকে ইসরাইলে স্থানান্তরিত করে।

লেবাননের রাজধানী বৈরুতের সাবরা ও শাতীলা অঞ্চলে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবিরে দখলদার যায়নবাদীদের সঙ্গে যোগসাজশে তাদের তাঁবেদার লেবাননের খ্রিস্টান ফালাঞ্জিস্ট মিলিশিয়ারা যে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় তার নৃশংসতা ও ব্যাপকতা দীর ইয়াসীনের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে যায়। ১৯৮২ সালের ১৬-১৮ সেপ্টেম্বর ফালাঞ্জিস্ট মিলিশিয়ারা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রহরাধীন শাবরা ও শাতীলা শরণার্থী শিবিরে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করে। এ ঘটনার পরে শিবির দু’টি পরিদর্শনকারী জনৈক কানাডীয় চিকিৎসকের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডের পর ৩০০-৫০০ নিহতকে এক একটি কবরে সমাহিত করা হয় এবং বুলডোজারের সাহায্যে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।

বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে সূচিত ফিলিস্তিনি জনগণের গণজাগরণ (প্রথম ইন্তিফাদা) দমনের লক্ষ্যে যায়নবাদীরা সম্ভাব্য সকল প্রকার পৈশাচিকতার আশ্রয় নেয়। যায়নবাদীদের গুলিতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু সংখ্যক লোক আহত হয় এবং পাঁচ বছরে মোট নিহতের সংখ্যা ১৬০০ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু যায়নবাদীরা যাদেরকে গ্রেফতার করে তাদের সঙ্গে যে পৈশাচিক আচরণ করে তা ছিল হত্যার থেকেও বীভৎস। দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথা ও কপালের চামড়া তুলে ফেলা, মাথার চুল উপড়ে ফেলা, চোখ তুলে নেওয়া, হাত-পা ভেঙে ফেলা, হাত-পা, পেট ও কান কেটে ফেলা; ইট-পাথরের আঘাতে মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া, অসুস্থ লোকদের হত্যা, নারীদের উদর কর্তন, মায়ের কোলে সন্তানের শিরচ্ছেদ, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, তরুণীদেরকে বন্দি করার পর উলঙ্গ করে ট্রাকে তুলে শহরের রাস্তায় ঘুরানো ইত্যাদি যায়নবাদীদের নিয়মিত কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বার্তাসংস্থা এপি তেল আবিব থেকে প্রদত্ত এক রিপোর্টে জানায়, সামরিক অফিসাররা বন্দি ফিলিস্তিনিদের হাড্ডি ভেঙে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বলে তিনজন ইসরাইলি সৈনিক এক সামরিক আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে। আর এ ব্যাপারে অভিযুক্ত একজন অফিসার বলে যে, এ নির্দেশ উচ্চতর পর্যায় থেকে এসেছে; প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর স্টাফ-প্রধান এবং অন্যান্য সামরিক অধিনায়কের পক্ষ থেকে এ নির্দেশ এসেছে। ইসরাইলের তাঁবেদার তথাকথিত দক্ষিণ লেবানন বাহিনী (এসএলএ)-ও ইসরাইলি নির্দেশে একই পন্থা অবলম্বন করে। ব্রিটিশ দৈনিক ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’-এর এক রিপোর্টে বলা হয়, দক্ষিণ লেবাননের খাইয়াম্ কারাগারে বন্দিদেরকে বৈদ্যুতিক শক্ দেওয়া হয় এবং পৈশাচিকভাবে মারপিট করা হয়।

‘মিড্ল্ ইস্ট্ টাইমস’ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে এক ব্রিটিশ মহিলা ডাক্তার বলেন, যায়নবাদীরা ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায় ও তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে থাকে। গাজা উপত্যকার এক হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, হাসপাতালে নিয়ে আসা নিহত ও আহতদের অর্ধেকের বেশিই হচ্ছে পনের বছরের কমবয়স্ক। তিনি আরও বলেন, ইসরাইলী সৈন্যরা আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে, এমনকি হাসপাতাল থেকে আহতদের জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এ ধরনের এক ঘটনায় এক ইসরাইলী ডাক্তারের (!) নেতৃত্বে ইসরাইলী সৈন্যরা অস্ত্রোপচার-কক্ষ থেকে বেহুঁশ অবস্থায় এক আহতকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্টে বলা হয়, ইন্তিফাদা দমনের লক্ষ্যে ইসরাইলী সৈন্যরা ব্যক্তিগত বাসভবন, ডাক্তারখানা, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ ইত্যাদিতেও হামলা চালায়। ফলে এর বেশিরভাগ শিকার হয় শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা। কাঁদানে গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় অনেকের মৃত্যুও ঘটে। ইন্তিফাদা শুরু হবার ছয় মাস পরে প্রকাশিত উক্ত রিপোর্টে ঐ সময় পর্যন্ত কেবল কাঁদানে গ্যাসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ায় ৪০ জনের মৃত্যু ঘটে। এদের মধ্যে ছয় মাসের কমবয়স্ক ১৮টি শিশু এবং ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে ১৭ ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ইসরাইল সফরকারী ৪৯ সদস্যের এক ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল বলেন, জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও গাজা এলাকায় ইসরাইল সরকার ‘বিজয়চিহ্ন’ প্রদর্শন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ইসরাইলী সৈন্যরা অত্যন্ত কঠোর পন্থায় এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করছে। ইসরাইলী সৈন্যরা বিজয়চিহ্ন দেখানোর দায়ে গ্রেফতারকৃত শিশুদেরকে পর্যন্ত মারধর করছে। একটি তিন বছরের শিশু এরূপ বিজয়চিহ্ন প্রদর্শন করায় তার মাকে গ্রেফতার করে হাজতে রাখা হয় বলে ‘জেরুসালেম পোস্ট’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়।

উক্ত বিবৃতিতে আরো বলা হয়, জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে প্রাপ্ত পানির এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করা হয় সেখানে বসতি স্থাপনকারী ৭০ হাজার ইহুদিকে, এক-তৃতীয়াংশ ইসরাইলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এক-তৃতীয়াংশ দেওয়া হয় জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ৯ লাখ ৩০ হাজার ফিলিস্তিনীকে, যারা সেখানকার জনসংখ্যার শতকরা ৯৩ ভাগ। ইন্তিফাদা দমনের লক্ষ্যে যায়নবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া এবং সীল করে দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালের ৯ ডিসেম্বর পথম ইন্তিফাদা শুরু হবার পর থেকে ১৯৯০ সালের ২৩ মে পর্যন্ত যায়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের ২৯৯টি বাড়ি বুলডোজার দ্বারা নিশ্চিহ্ন করে ফেলে এবং আরো ১৮৭টি বাড়ি সীল করে দেয়। পাইকারি হারে গ্রেফতার, দীর্ঘদিন যাবৎ কারান্তরালে ফেলে রাখা, কারাগারে নির্যাতন, নির্যাতনের ফলে বন্দির মৃত্যু ইত্যাদি ইসরাইলের ফিলিস্তিনিবিরোধী প্রাত্যহিক কর্মসূচি। মাঝে মাঝে এ নিয়ে বন্দিদের অনশন ধর্মঘটের ঘটনাও ঘটছে।

আরবদেরকে তাদের বসতি থেকে উৎখাত এবং সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন ইসরাইলের একটি স্থায়ী পরিকল্পনা। কিন্তু এই পাশবিক পরিকল্পনা তারা শুধু অধিকৃত ফিলিস্তিনেই কার্যকর করেনি; বরং ১৯৮২ সালে লেবানন দখলকালে সেখানেও তারা (ইহুদি বসতি স্থাপনে সক্ষম না হলেও) যথারীতি উৎখাত তৎপরতা চালিয়েছিল। যেমন ঐ সময় ইসরাইলের তাঁবেদার অ্যান্টন লাহাদ নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ লেবাননের সীমান্তবর্তী এলাকার আরব অধ্যুষিত শহর সালিম-এর ৭ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ৬৬০০ জনকে উৎখাত করা হয়। এছাড়া আইনুল হাল্ওয়াহ্ ও আমিয়াহ্ ওয়ামিয়াহ্ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবিরের ২২ হাজার লোককেও তারা উৎখাত করে। যায়নবাদীদের উৎখাত তৎপরতা থেকে ফিলিস্তিনি খ্রিস্টানরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। ঐ সময় নিরাপত্তা এলাকা গঠনের নামে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সঙ্গে ৪০০ খ্রিস্টান পরিবারকেও উৎখাত করা হয়।

সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার দেওয়া মারণাস্ত্রে সজ্জিত ও তার রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট যায়নবাদী ইসরাইল ১২ জুলাই ২০০৬ পুনরায় লেবাননে সামরিক হামলা চালায় এবং দেশটির দক্ষিণাংশ দখল করার পর শেষ পর্যন্ত লেবাননের হিযবুল্লাহ্ গেরিলাদের প্রতিরোধের মুখে পরাজয় মেনে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। যায়নবাদী ইসরাইল হিযবুল্লাহ্ গেরিলাদের দমনের নামে এ হামলা শুরু করলেও কার্যত ইসরাইলী বাহিনী লেবাননের নিরীহ বেসামরিক লোকদের নির্বিচারে হত্যা করে। লেবাননে তারা চরম পৈশাচিকতার আশ্রয় নেয়। ইসরাইলী বাহিনীর হামলা থেকে হাসপাতাল ও ত্রাণসামগ্রীবাহী যানবাহন পর্যন্ত রেহাই পায়নি। এমনকি তারা দক্ষিণ লেবানন থেকে পলায়নরত লোকদেরকেও পথিমধ্যে বোমাবর্ষণ করে হত্যা করে। বিশেষ করে লেবাননের ক্বানা শহরে জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত একটি উদ্বাস্তু-আশ্রয়কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে যায়নবাদীরা যে গণহত্যা চালিয়েছে তাতে তাদের মদদদাতা পাশ্চাত্য ছাড়া বিশ্বের সকল মানুষই মর্মাহত হয়েছে। তাদের এ পৈশাচিকতা অনেককে বিস্মিত করেছে। কিন্তু যায়নবাদীদের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা এতে মোটেই বিস্মিত হননি। যায়নবাদীদের গোটা ইতিহাসই মানবতাবিরোধী পৈশাচিক অপরাধে পরিপূর্ণ।

ইসরাইল গাজার ওপর ২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর বিমান হামলা ও ২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারি স্থলপথে হামলা শুরু করে। এই সময় ইসরাইলি জঙ্গী বিমান গাজার থানা, স্থানীয় প্রশাসনিক অফিস, বিভিন্ন স্কুল, রাষ্ট্রসংঘের গুদাম, হামাস সরকারের বিভিন্ন অফিস ভবন, গাজা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবন, রাষ্ট্রসংঘ পরিচালিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবিরের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। কেবল প্রথম পাঁচ দিনেই ৪৩৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ২৮০০ জন আহত হয়। ইসরাইলি বাহিনী গাজার পানি ব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থারও ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ইসরাইলের এই আগ্রাসনে গাজার ৫ হাজার বাড়ি, ১৬টি ভবন ও ২০টি মসজিদ পুরোপুরি ধ্বংস হয় এবং আরো ২৫ হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আগ্রাসনে মোট প্রায় ১৪০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক ফিলিস্তিনি নাগরিক, নারী ও শিশু। নিহতদের মধ্যে ২৫২ জন ছিল শিশু।

যায়নবাদী ইসরাইলের পৈশাচিকতা সব সময়ই অব্যাহত ছিল এবং এখনো সমানে জারি রয়েছে। এখানে কেবল কয়েকটি বড় বড় ঘটনার কথা অত্যন্ত সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল। কিন্তু যায়নবাদীদের পৈশাচিকতা কেবল হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাদের নির্যাতন-নিপীড়ন এতই ভয়াবহ যে, অনেকেই এদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার পরিবর্তে শহিদ হওয়াকে অগ্রাধিকার দেবে। ফিলিস্তিনিদের ওপর যায়নবাদীদের যুলুম-নির্যাতন শুধু হত্যা, উৎখাত, শারীরিক নির্যাতন, জেল-যুলুম ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পাশাপাশি তারা মানসিক নির্যাতন এবং সাংস্কৃতিক বিকৃতি সাধনের তৎপরতাও জোরকদমে চালিয়ে যাচ্ছে। আর এসব পৈশাচিকতা করা হয় পরিকল্পিতভাবে এবং সরকারী নির্দেশে।

১৯৬৭ সালের জুন মাসের যুদ্ধে গাজা ও জর্দান নদীর পশ্চিম তীর দখলের পর কার্যত ইসরাইল এই দু’টি এলাকাকে পুরোপুরি দখল করে নেয়। ঐ সময় অনেক আরবীয় অধিবাসী অন্য এলাকায় চলে যায়। আর ইসরাইল তার দখলের অব্যবহিত পরেই আদমশুমারি করে এবং এভাবে ঐ সময় সেখানে ছিল না এমন লোকদেরকে ঐ এলাকা দু’টির অধিবাসী বলে অস্বীকার করে। ফলে যেসব পরিবার স্থানত্যাগ করেছিল তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ পরিবারসমূহ বিপদের মুখে পড়ে যায়। কারণ, অনেক নারীকে ঐ সময় তাদের পিতা-মাতা ঐ এলাকায় না থাকায় বিদেশী হিসেবে গণ্য করা হয়, যদিও তাদের স্বামীরা ঐ এলাকার অধিবাসীরূপে পরিগণিত হয়। এ ধরনের নারীদের অনেককেই সন্তান-সহ বহিস্কার করা হয়। তারপর তাদেরকে রীতিমত ভিসা নিয়ে নিজ এলাকায় প্রবেশ করতে হত। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ চাইলে তাদের ভিসা নবায়ন করত অথবা নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানাত। ১৯৮৯ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঐ বছর ২৫০ জন মা ও সন্তানকে ভিসার মেয়াদ পার হয়ে যাওয়ায় জর্দান নদীর পশ্চিম তীর থেকে বিতাড়িত করা হয়। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি অবশ্য এরূপ দশজন মহিলা ভিজিট-ভিসা নিয়ে স্বীয় পরিবারের নিকট প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হয়।

যায়নবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর সাংস্কৃতিক নির্যাতনও চালায়। তারা ফিলিস্তিনিদের শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন অছিলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ করে দেয়। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বই-পুস্তকের অনুবাদ নিষিদ্ধ করে দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক স্তরে কয়েকটি সূরা পড়ানো ছাড়া সমগ্র কুরআন মজীদ শিক্ষাদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ  পড়ানো বাধ্যতামূলক করে। এমনকি তারা বেশ কিছু আয়াত বাদ দিয়ে ও বহু আয়াত বিকৃত করে কুরআন মুদণের পদক্ষেপও প্রহণ করে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনি ও লেবানিজদের মধ্যে নেশার দ্রব্যের ব্যাপক প্রচলনের জন্য যায়নবাদী ইসরাইল ও তার তাঁবেদার দক্ষিণ লেবানন বাহিনী ব্যাপক তৎপরতা চালায়। ১৯৭৫ সাল থেকে তারা এ জাতীয় তৎপরতা চালিয়ে আসছে।

অর্থ, মাদক দ্রব্য ও নারী ইত্যাদির মাধ্যমে যায়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের নৈতিকতার বিনাশ সাধন এবং তাদের মধ্যে নিজেদের দালাল সৃষ্টির ঘৃণ্য তৎপরতা চালিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে বিপ্লবীদের হাতে এ জাতীয় দালাল ধরা পড়ে এবং বৈপ্লবিক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। বিপ্লবী ফিলিস্তিনিরা প্রথম ইন্তিফাদার প্রথম তেত্রিশ মাসে (১৫ সেপ্টম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত) ইসরাইলের দালালি ও অনৈতিকতার দায়ে ২৩০ জনেরও অধিক ফিলিস্তিনিকে বৈপ্লবিক মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা-কালে এ ধরনের ৫৯৩ জন ফিলিস্তিনি শত্রুর সঙ্গে যোগসাজশের অপরাধে মুজাহিদদের হাতে নিহত হয়।

১৯৬৭ সালের জুন মাসে যুদ্ধের পর থেকে ইসরাইল সাড়ে ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও প্রায় ১২ হাজার ফিলিস্তিনি ইসরাইলের কারাগারে ছিল।
বস্তুত এ এক বিতর্কাতীত সত্য যে, ফিলিস্তিনের বুকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাইরে থেকে ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনি জনগণের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে তাদেরকে উৎখাত করে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় মূলত ব্রিটেন ও মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায়। তারপর এ রাষ্ট্রটির ইতিহাস হচ্ছে ফিলিস্তিনি ও লেবাননিজ জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন, সন্ত্রাস ও পৈশাচিকতার ইতিহাস। এহেন একটি মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান একেবারেই অসম্ভব। বরং ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হল সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সন্ত্রাসের হোতা এই অবৈধ রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব ধরণীর বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলা।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: