অভিমত
খারেজি মাদ্রাসায় জঙ্গি তৈরি হয় – এটা মিডিয়ার বানানো গল্প ছাড়া কিছুই নয়; বরং দেশের আশ্রমিক, টোল, চতুষ্পাঠী, মক্তব প্রভৃতি ট্র্যাডিশনাল শিক্ষার একটি বহমান ধারা। তবে সোসাইটি বা ট্রাস্ট পরিচালিত এই মাদ্রাসাগুলির অধিকাংশেরই পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে (যদিও সোসাইটি অ্যাক্টে প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে তার আইনি বৈধতা নেই, তার শংসাপত্র স্কুল কলেজে গ্রহণযোগ্য নয়)। যেহেতু সেখানে শিশু-কিশোররা পড়ে, তাই শিক্ষার অধিকার আইন ও সংবিধান মেনে শিক্ষা দপ্তরের অনুমোদন নিয়ে কীভাবে সার্বিক বিকাশ করা যায়, তার আশু সমাধান প্রয়োজন (এতিম ও দুস্থদের বিষয়টি মাথায় রেখে)। তবে এই মাদ্রাসাগুলির কারিক্যুলাম যাঁরা তৈরি করছেন, তাঁদের কাছে বিনীত অনুরোধ সমাজ চিন্তক, শিক্ষাবিদ, উদ্যোগপতি, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালক প্রমুখের সঙ্গে খোলাখুলি বৈঠকে বসুন। নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনে মডেল করে গড়ে তোলা সময়ের দাবি। প্রয়োজনে সংবিধান সম্মতভাবে সেল্ফ ফিনান্স বা সংখ্যালঘু প্রাপ্তিষ্ঠান হিসেবেও গড়ে তুলতে পারেন- খ্রিস্টান মিশন, রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ তারাও নিজেদের ধর্মীয় স্বকীয়তা বজায় রেখে গুণগত মানের নিরিখে যে জায়গায় গেছে, আমাদের মাদ্রাসা বোর্ড পরিচালিত সরকারি বা সরকার পোষিত মাদ্রাসাগুলিও তাদের থেকে শত যোজন দূরে। অথচ এরা সংবিধানের ৩০ ধারা মোতাবেক সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছে। প্রয়োজনে আপনারাও সংবিধানসম্মত উপায়ে মাইনোরিটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দাবি করুন। সরকার আপনাদের সাহায্য দিতে বাধ্য। যেভাবে খ্রিস্টান মিশন, রামকৃষ্ণ মিশন বা ভারত সেবাশ্রম সংঘগুলি পরিচালিত।
মনে রাখতে হবে, এ দেশের উপর দিয়ে অনেক সভ্যতা চলে গেছে। এখন যে সভ্যতা হেঁটে চলেছে তা হল পলিটিক্যাল সভ্যতা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদ ও ধর্মীয় মেরুকরণ। আর সংখ্যালঘু বিদ্বেষ তাদের রাজনীতির হাতিয়ার। মিডিয়াকে নামানো হয়েছে সেই বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য।
তবে আমাদের আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণ এই সময়ে সবচেয়ে জরুরী। কীভাবে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আত্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারে। রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে জোর দিক নিজেদের মেধা, মনন, প্রজ্ঞা ও যুক্তিবাদী মানসিকতার উপর। তবে স্বকীয় রাজনৈতিক দল করলে সফল হওয়া মুশকিল। তাই যে কোন গণতন্ত্রপ্রেমী, সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী দলের সঙ্গেই যেতে হবে।
মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশ আমলে আমাদের সমাজ চিন্তকদের একরোখা মনোভাবে ইংরেজদের ভাষা ও শিক্ষা থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। ফলত ঊনবিংশ শতকে যে নবজাগরণ এসেছিল, তা তো পক্ষান্তরে হিন্দু জাগরণ। আমাদের বোধোদয় হয় ১০০ বছর পরে। বিংশ শতকে আমাদের সমাজে যেই একটু একটু করে আলো দেখা, ওমনি দেশ ভাগ, তারপর এপার বাংলায় রয়ে যাওয়া প্রান্তিক মানুষগুলো অভিভাবক হারিয়ে এক হীনম্মন্যতায় আচ্ছন্ন ভোট ব্যাংকে পরিণত হয়। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। ৮০-র দশকে কিছু মুসলিম তরুণের উদ্যোগে মিশন শিক্ষা আন্দোলন শুরু। তার ফলে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা প্রতি বছর বেশ ভাল সংখ্যায়য় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পাচ্ছি। সেই অনুপ্রেরণা নিয়ে মুসলিম মহল্লাগুলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো অপরিকল্পিতভাবে গজিয়ে উঠছে কেজি স্কুল, মিশন। তাঁদের শিক্ষা দর্শন কী? জীবন- জীবিকা ও নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা কি সেই দিশা দেখাতে পারছে বা পারবে? যা নিজের সমাজ তো বটেই, প্রতিবেশীরা সেই প্রতিষ্ঠানগুলিতে আগ্রহী হচ্ছে? যেমন- খ্রিস্টান মিশন বা রামকৃষ্ণ মিশনগুলির প্রতি যে ধারণা পোষণ করা হয়?
তাছাড়া মিশনকেন্দ্রিক, বেসরকারি শিক্ষা ক্রয় করার মতো ক্ষমতা ৯০ শতাংশ প্রান্তিক মানুষের নেই। গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষগুলির ভরসা সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সাধারণের বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান কঙ্কালসার চেহারা দেখে মন বড়ই ভারাক্রান্ত। সেই সাথে শিক্ষক-অভিভাবক ও পড়ুয়াদের নৈতিক অধঃপতন আরও বেশি করে ভাবাচ্ছে- যে আগামীর দিনগুলি সত্যি ভয়ঙ্কর। যে বিদ্যালয় বলা হয় সমাজের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ, সেখানে আজ কোন মূল্যবোধ, নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার নেই। ড্রেস কোড তো অনেক স্কুল, মাদ্রাসা থেকে কবেই বিদায় নিয়েছে। তার সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের হেয়ার স্টাইল, ফ্যাশন, শরীরে ট্যাটু, উল্কি, ছেলেদের কানে দুল, হাতে বালা পরে স্কুলে আসছে। ডাক্তার যেমন চেহারা দেখে রোগের কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন, তেমনি বিদ্যালয়গুলিতে কী হচ্ছে, তার গভীর মূল্যায়ন না করেও কিছু উপসর্গ দেখেও বুঝতে পারবেন। আর শিক্ষক শিক্ষিকাদের হাত-পা এখন বাঁধা, শাসনের ছড়ি তো দূর; বকাঝকা করতেও ভয় পাচ্ছেন। আর এই পরিবেশে গড়ে উঠছে প্রান্তিক সমাজের সন্তানরা। দুধে ভাতের উচ্চবিত্ত, নেতা মন্ত্রী আর সরকারি-আধা সরকারি কর্মীদের সন্তানরা কবেই সাধারণের বিদ্যালয়কে পত্রপাট বিদায় জানিয়ে বাণিজ্যিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেছে নিয়েছে (ক্ষুদ্র শতাংশ ব্যতিক্রম)।
ফলে শিক্ষার এহেন সংকটকালে নৈতিক, আধাত্মিক ও জাগতিক ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনের মডেল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই মুহূর্তে সমাজচিন্তক, শিক্ষাবিদ, উদ্যোগপতি, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালক প্রমুখের সঙ্গে খোলাখুলি বৈঠকে বসুন। আত্ম সমালোচনা ও পর্যালোচনা করুন। আর এই যে জঙ্গি অপবাদ – সেটা অভিসন্ধিমূলক ও ক্ষণস্থায়ী। আপনি জগতের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন, মাদ্রাসার দরজা সকলের কাছে উন্মুক্ত করুন। সরকারের অনুমোদন নিয়েই সিলেবাস কারিক্যুলাম তৈরি হোক বিজ্ঞান, সাহিত্য নিয়ে পড়বে তাঁরা পড়ুক। আর ফিকাহ শাস্ত্র, হাদীস তাফসীর নিয়ে যারা পড়বে পড়ুক। সংবিধানের ৩০ ধারার সুযোগ নিয়ে মাদ্রাসা বোর্ড উৎকর্ষের যে জায়গায় পৌঁছতে পারেনি, আমি বিশ্বাস করি খারেজি মাদ্রাসাগুলির পরিচালকমণ্ডলী যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সেই কাজ করতে পারবে। কারণ, এতিম ও দুস্থদের জন্য দান, যাকাত গ্রহণের দরজা যেমন এখানে উন্মুক্ত, সঙ্গে মাহিনা দিয়ে পড়ার পরিকাঠামো গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। তাছাড়া কর্মরত শিক্ষকরা স্বল্প বেতন নিয়ে যে অসম্ভব রকমের পরিশ্রম করেন, তাঁদেরকে আরও একটু আর্থিক সহযোগিতা এবং এই মুহূর্তে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা বিভাগের অসংখ্য মেধাবি বেকার যুবক হতাশায় ভুগছেন। তাদেরকে মোটামুটি সম্মানজনক বেতন দিয়ে শিক্ষার নব দিগন্ত গড়ে তোলা সম্ভব। আমি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত, এই প্রতিষ্ঠানগুলি গুণগত মান ও উৎকর্ষের সেই চূড়া স্পর্শ করলে মননে ঘৃণা পোষণকারী দালাল মিডিয়ার কর্মচারী, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী থেকে শুরু করে বাবুশ্রেণির সন্তানরা আপনার প্রতিষ্ঠানে জঙ্গি খুঁজতে নয়; অ্যাডমিশন নেওয়ার জন্য সিট খুঁজতে আসবে।
এম রুহুল আমিন, ভাঙ্গড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা