কুকি ও নাগা প্রসঙ্গের ইতিবৃত্ত

মীযানুল করীম
উত্তর-পূর্বে ৩৩ লাখ জনসংখ্যার রাজ্য মনিপুরে ৪৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীই কুকি ও নাগা। বাকি ৫৭ শতাংশ মইতই সম্প্রদায়ভুক্ত; অর্থাৎ তারা জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। গত তিন মাসে সেখানে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। মনিপুরে সঙ্কট বেশ বীভৎসভাবে উন্মোচিত হয়েছে। মনিপুরের এ জাতিগত বিবাদে এখন পর্যন্ত ১৫০-রও বেশি মানুষ নিহত এবং অন্তত ৫০০জন কমবেশি আহত হয়েছে। কমপক্ষে ৬০ হাজার বাসিন্দাকে নিজেদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে। পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীই শুধু নয়; সেনাবাহিনীও মোতায়েন করতে হয়েছে, তবুও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আপাতত এই পাহাড়ী রাজ্যে শান্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। মইতইরা হিন্দুধর্মের অনুসারী এবং তাদের কিছু লোক অপরিচিত আনামাহি ধর্মমতের অনুসারী। অন্য দিকে কুকি ও নাগা উপজাতিরা প্রধানত খ্রিষ্টান। তাদের অভিযোগ, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাদের গির্জা, বাড়িঘর ও জায়গা-সম্পত্তি ধ্বংস করে দিচ্ছে।
কুকিচিনদের তৎপরতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের কিছু স্মৃতি মনে উঁকি দেয়। তখন ওই এলাকায় মনিপুরীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে মৌদক মৌয়াল স্থানের নাম ছড়ায়। মনিপুর দিয়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদহিন্দ ফোর্স ঢুকে পড়েছিল। তাদের সৈন্যরা জাপানিদের সহায়তায় মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল দিয়ে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হয়। এই কুকিচিনরা নাগা-লুসাইদের ঘনিষ্ঠ। তারা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ও ইংরেজি ভাল জানে।
কুকি বা নাগাদের মূল ভূমি এখন মিয়ানমারের চিন প্রদেশ। এটি বাংলাদেশের বান্দরবানের পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর সংলগ্ন ভারতীয় প্রদেশ মিজোরাম রাজ্য, যার রাজধানী আইজল। দেমাগিরি ও লুংলে এর অপর দু’টি বিখ্যাত জায়গা। মিজোরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে লুসাই বা নাগা সম্প্রদায়ের বসবাস। এদেরই অন্তর্ভুক্ত ডনডন লুসাই, রামা লুসাই প্রমুখ ভাই, এমনকি মেয়েরাও জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়।
মণিপুর রাজ্যে ৪০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন রয়েছে। ‘দ্য ফ্রন্টিয়ার’ মণিপুরের সম্পাদক বলেছেন, মণিপুরে বর্তমান সঙ্ঘাত জাতিগত, যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হচ্ছে না। মণিপুর সঙ্ঘাতের প্রথম দিকে খবর প্রচারিত হয় যে, একদল উপজাতীয় কুকি (খ্রিস্টান) সশস্ত্র যোদ্ধা এক মইতই (হিন্দু) নারীকে ধর্ষণ করেছে। তখন মইতই জনগোষ্ঠী প্রতিশোধ নেয়। বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটে অনেক মইতই লোকের বসবাস। এরা প্রধানত হিন্দু। মৌলভীবাজার জেলায় এরা মণিপুরী সাহিত্য সংস্কৃতি, নৃত্য, কবিতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গত ৪ মে মণিপুরী উপজাতি নারী মইতই জনতার হাতে অমানবিক ও পাশবিক কায়দায় ধর্ষিত হবার পর নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানো হলে সমগ্র ভারত উত্তাল হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মণিপুর প্রসঙ্গে এতদিন কোনো মন্তব্যই করেননি। অবশেষে ৮০ দিনের মাথায় এ পাশবিক ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিলেন। কিন্তু তিনি কেন এত সময় নিলেন?
নরেন্দ্র মোদির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির নেতৃত্বাধীন বীরেন সিংহ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মণিপুর শাসন করছেন। তিনি হিন্দু মইতই সম্প্রদায়ভুক্ত। মণিপুর রাজ্যে বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৪০টি এই হিন্দু মইতই সম্প্রদায়ের দখলে। বীরেন সিংহ কুকি উপজাতীয় এবং পপি চাষ করাকে বর্তমান সঙ্কটের জন্য তিনি দায়ী করছেন।
মণিপুরে সৈন্যবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ ৪০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন আছে। কিন্তু বিশেষ করে উপজাতিরা নিজেদেরকে নিরাপদ বলে মনে করছে না এবং শান্তির কোনো লক্ষণ নেই। উপজাতিদের অভিযোগ, তফসিলি জাতি বা উপজাতি হিসেবে মইতইরা পাহাড়ে অনুপ্রবেশ করে। ওরা পাহাড়ি উপজাতিদের জমি দখল করতে চায়। এ জন্য উপজাতিরা মইতইদের তফসিলি জাতি বা উপজাতি (এসসি-এসটি) হিসেবে গণ্য করার বিরুদ্ধে। কুকি নাগাসহ উপজাতি জনগোষ্ঠীর বক্তব্য, তফসিলি সম্প্রদায়যুক্ত হলে সমতলের অধিবাসী মইতইরা শক্তিশালী হবে।
এমনিতেই মণিপুর প্রদেশের রাজনীতি, সরকার ও সমাজে মইতইরা খুবই প্রভাবশালী। উপজাতিদের বক্তব্য, মইতইরা পাহাড়ি নয়; সমতলবাসী। তারা তফসিলি হলে কুকি অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকায় জমি কিনে বসত গড়ার সুযোগ পাবে। বীরেন সিংহের বিজেপি সরকার মূলত মইতই প্রভাবিত এবং এ কারণে উপজাতিদের উচ্ছেদ করতে চায়। উল্লেখ্য, কুকিদের কোমরে একধরনের ধারালো ছোরা গোঁজা থাকে, যা ভোজালি নামে পরিচিত। মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল ছাড়াও চূড়া চাঁদপুর বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত এবং সেখানেও এবারের ঘটনা ঘটেছে। একদা মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুহাম্মদ আলিমুদ্দীন সাহেব। বাংলাদেশে বহুল আলোচিত টিপাইমুখবাঁধ বরাক নদীর উপরে মণিপুরের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত।
মিয়ানমার থেকে আসা অভিবাসী বা শরণার্থীরাও মণিপুরের অসন্তুষ্টির কারণ। মণিপুরে অনেক রকম সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে এবং তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে। কুকি ও মইতইরা পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত লড়াইয়ে ব্যস্ত। বর্তমান সঙ্কটের এটি অন্যতম প্রধান কারণ। নাগাদেরও সশস্ত্র দল রয়েছে, যারা একটি খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠায় উদগ্র। মইতইরা বাংলাদেশে সাধারণত মণিপুরী নামে পরিচিত এবং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহা মণিপুরী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: