অপারমাণবিক বোমা

ডা. মসিহুর রহমান

ইহুদী বিজ্ঞানীদের সহায়তায় বিশ্বে প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি হয়। আজ সারা বিশ্ব যে পরমাণু যুদ্ধের ভয়াবহ আতঙ্কে ভুগছে তার জন্য এইসব বিজ্ঞানীরা দায়ী। পরমাণু বোমা তৈরির প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পরমাণু শক্তিধর দেশ হবার প্রতিযোগিতায় অনেক দেশ লিপ্ত।

ইহুদী বিজ্ঞানীরা আমেরিকা সরকারের সার্বিক সহায়তায় পরমাণু বোমা তৈরি করতে সক্ষম হন। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে একটি চিঠি লিখে পরমাণু বোমা তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ করার অনুরোধ করেছিলেন। রুজভেল্ট তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে বোমা তৈরির জন্য যদি অর্থ বরাদ্দ না করতেন তাহলে ইতিহাসের গতি অন্য খাতে হয়ত প্রবাহিত হত। হিটলারের প্রতি ঘৃণা থেকে যারা পরমাণু বোমা তৈরির গবেষণায় অংশ নেন তাদের বেশিরভাগই ইহুদী বিজ্ঞানী।

আশ্চর্যের বিষয়, ইহুদী নিধনে জার্মানির হিটলার দায়ী হলেন, আর পরমাণু বোমার আঘাতে ইউরোপ নয়, এশিয় জাপানকে নিদারুণভাবে ভুগতে হল। হিটলার হলেন খ্রীস্টান। ইহুদীরা তাদের দ্বারাই নির্যাতিত হয়েছিল। কিন্তু সিন্টো ও বৌদ্ধ ধর্মের দেশ জাপানের ঘাড়ে বোমা ফেলা হল। এ এক রহস্যময় অভিজ্ঞতা!

১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট আইনস্টাইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লেখেন পরমাণু বোমা তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ করার অনুরোধ জানিয়ে। পরমাণু বোমা তৈরির শেষের দিকে অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভবলীলা সাঙ্গ হয়। হ্যারি ট্রুম্যান ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন। তিনি ক্ষমতায় এসে সদ্য তৈরি পরমাণু বোমা যুদ্ধরত জাপানের ওপর ফেলার অমানবিক ও পৈশাচিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও নির্দেশও দেন। জাপানের হিরোশিমা শহরে ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট প্রথম বোমা নিক্ষেপ করা হয়। নাগাসাকিতে পুনরায় নিক্ষেপ করা হয় ১৩ দিনের মাথায়। জাপান নিঃশর্তভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে।

আজো জাপান পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জর্জরিত। পারমাণবিক বোমা কতটা ভয়ঙ্কর, তা জানা সত্ত্বেও শক্তিধর দেশগুলি তাদের নীতি পাল্টায়নি। শক্তিধর দেশগুলি পারমাণবিক বোমায় সজ্জিত। কিন্তু অন্য কোন দেশ এই বোমা বানাক তা করতে দিতে আদৌ রাজি নয়। ঠিক আছে, যদি মানবতাকে পারমাণবিক সহিংসতা, সন্ত্রাস থেকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে শক্তিধর দেশগুলিও পারমাণবিক বোমাগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে বিশ্বকে শাপমুক্ত করুক। কিন্তু শক্তিধর দেশগুলি বিশ্বে দাদাগিরি‘ করার জন্য সেই নীতিতে বিশ্বাসী হতে চায় না। বিশ্বকে শক্তিধর দেশগুলি শাসন করতে যে কোন পাপ করতে রাজী। যে কোন অন্যায়, অনৈতিক কার্যকলাপকে তারা বৈধ করে নিয়ে থাকে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য আজ পর্যন্ত তারা সম্মিলিত ভাবে বিশ্বকে গণতন্ত্রের সবক শেখাতে পারেনি। এরা গণতন্ত্রের কথা বলে থাকে, কিন্তু নিজেদের স্বার্থে তারা গণতন্ত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়। বস্তুতপক্ষে জাতিসংঘ হল ‘কফিন চোর’। আল্লামা ইকবাল একে ‘কফিন চোর’ আখ্যা দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি গড়ে ওঠে। লিগ অফ ন্যাশনস ব্যর্থ হলে একে আবার জন্ম দেওয়া হয়। আজ পর্যন্ত জাতিসংঘ ন্যায়, ইনসাফ কায়েম করতে সফল হতে পারেনি। শক্তিধর দেশগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হতে পারেনি। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। তা-ও আবার আমেরিকার ভেটোর বলে ব্যর্থ হয়েই চলেছে। ইরাক, আফগানিস্তানের ওপর আমেরিকা-সহ ন্যাটো বাহিনীর নির্মম, অমানবিক ও একেবারেই অন্যায় হামলার কোন সুরাহা করতে পেরেছে? না পারেনি। পারা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়েছে কি? না হতে পারেনি। উইঘুরের মুসলিমদের ওপর চীনের নিষ্ঠুর নির্যাতন তাকে দমাতে পারা গেছে কি? না পারা যায়নি। ভবিষ্যতে সম্ভব হবে কি না তা এখন বলা শক্ত।

মার্কিন সমরবিদরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সর্বশক্তিশালী অপারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলেছে। এ-ও মানবতার জন্য এক বড় হুমকি। অপারমাণবিক বোমার নাম দেওয়া হয়েছে মাদার অফ অল বোম্বস। এই বোমা পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে ১১ টন টিএনটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী বলেছে। এই নিয়ে প্রচার করে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে মার্কিন মুলুক। সারা বিশ্বে দাদাগিরি ফলাতে চাইছে। রাশিয়াও বলছে, এমন অপারমাণবিক বোমা তাদের কাছেও আছে। আমেরিকাতে ২০০২ সালে এই বোমার নকশা তৈরি হয়। ২০০৩ সালে না-কি এই বোমার উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। এই নিয়ে সন্দেহ কারো কারো মনে হয়ত আছে যে, আমেরিকা সত্যিই মাদার অফ অল বোম্বস তৈরি করতে আদৌ পেরেছে কিনা।

যাহোক, ৯৮০০ কেজি ওজন বিশিষ্ট এই বোমা ৯.৮৮৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০৩ সেন্টিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট এই ভয়ঙ্কর বোমাটি ১১টন টিএনটি বিস্ফোরক ক্ষমতা বিশিষ্ট। এর উৎপাদন খরচ প্রায় ২.২৫ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। প্রতি ইউনিট তৈরির জন্য এমন খরচ লাগে। আমেরিকা সমরাস্ত্রে এত খরচ করছে কেন? কেবল বিশ্বে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে বজায় রাখার জন্যই। আমেরিকা এত সমরাস্ত্র তৈরি করে বিশ্বের বাজারে বিপুল পরিমাণে বিক্রি করে থাকে। সমরাস্ত্র তৈরি করেই তার বাজেটের সিংহভাগ আয় হয়ে থাকে। না হলে দেশটি উন্নত দেশ-ই হতে সক্ষম হতে পারবে না।

সমরাস্ত্র বিক্রি এমনি এমনি হবে না। এর জন্য চাই যুদ্ধ-যুদ্ধ কৌশল। ঠিক এই কারণেই যুদ্ধ লাগানো হয়। যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। রাশিয়া, ফ্রান্স-ও যুদ্ধাস্ত্র বিক্রিতে পারদর্শী দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। পশ্চিমারা অনেক বড় বড় নীতির বুলি আউড়িয়ে থাকে। কিন্তু তাদের হৃদয়-মন একেবারেই অন্য রকম। এদের দ্বিমুখী চরিত্র সবার জানা। এর স্থূল কারণ পশ্চিমা সমাজের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। চরম বস্তুবাদী, আল্লাহ-বিমুখ এই জাতি। এরা হযরত ঈশা (আ:)-এর শিক্ষাকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে একেবারেই বিদায় দিয়ে বসে আছে। এরা প্রাচীন গ্রীক, রোমান পৌত্তলিকতা সর্বস্ব নীতি-নৈতিকতাকে এই জায়গায় স্থান দিয়েছে। পার্থিব সর্বস্বতা এদের সামাজিক জীবনকে ঘিরে ধরেছে। ধর্মহীনতা, বস্তুবাদিতা সমাজকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলেছে। রাষ্ট্রনেতারা সেই আদর্শ ও নীতিকে অনুসরণ করতে চায়নি, যা তাদেরকে মহৎ মানবতাবাদী করে তুলবে। আল্লাহ-বিমুখ সমাজের পরিণতি যা হবার তা-ই হয়েছে। তাই যুদ্ধ ছাড়াও মানুষের চারিত্রিক অধঃপতনের প্রায় সব আয়োজন করে ফেলেছে। যৌন বিকৃতি ও বিচ্যুতি, সমকামিতা, এলজিবিটি, মাদকতা, দুর্নীতি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, বিবাহ-বহির্ভূত জীবনাচার, বিপর্যস্ত পারিবারিক জীবন পাশ্চাত্য সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ সভ্যতা বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না।

যে অপারমাণবিক বোমার কথা বলা হচ্ছিল, যা মাটির ৩০০ ফুট নীচে অবস্থিত ব্যাংকার ধ্বংস করতে পারে। এর অভিঘাতে ১.৭ মাইল অঞ্চলের মধ্যে থাকা সব প্রাণী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তেমনি দুই মাইল এলাকা পর্যন্ত মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পৃথিবী আরও এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হল।

 

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: