গাজার ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে ফিলিস্তিনি তরুণীদের ডিজিটাল উদ্যোগ

তালহা হাসান

ইসরাইল চায় গাজা তথা ফিলিস্তিনের ইতিহাস-ঐতিহ্য সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাক। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তারা মাঝেমধ্যেই অসহায় ও সর্বহারা গাজাবাসীর ওপর বিমান হামলা চালায়। কিন্তু ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষা করতে না পারলে একটা জাতি বা একটা ভূখণ্ড আপনা হতেই শেষ হয়ে যায়। এটা ইসরাইল জানে বলেই গাজা উপত্যকার নাম নিশানা চিরতরে মুছে দিতে পাঁয়তারা করে চলেছে সুদীর্ঘ সাড়ে ৭ দশক ধরে। তাই গাজা উপত্যকার অতীত সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছে একদল শিক্ষিত তরুণী। তারা সেখানকার পুরনো বই-পুস্তক ও দুর্লভ পাণ্ডলিপি সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় সহায়তা করতে নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণের এই প্রকল্প হাতে নিয়ে জোর কদমে কাজ করছে ”দি আইস অন হেরিটেজ ফাউন্ডেশন”। এর তত্ত্বাবধানে হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নথিভুক্তির কাজ করছেন ফিলিস্তিনের ৯ জন উদ্যমী তরুণী। তাঁরা পুরনো বইপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, পাণ্ডুলিপি, পত্র-পত্রিকা, পুরনো নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সংরক্ষণ করছেন।
২০১৭ সাল থেকে তাঁরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এই উদ্যোগে কাজ করছেন। তাঁদের এই প্রকল্পে সহায়তা করছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম। এর মধ্যে শত বছর থেকে শুরু করে হাজার বছরের পুরনো অনেক বিরল ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি রয়েছে। এর মাধ্যমে ফুটে উঠবে ফিলিস্তিনের দক্ষিণাঞ্চল বা গাজা উপত্যকার সমৃদ্ধ ইতিহাস।
কিন্তু ইসরায়েলী অবরোধের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এই প্রকল্প। গাজা সীমান্তবর্তী এলাকার দীর্ঘ প্রতিবন্ধকতা গবেষণার নথি সংরক্ষণ কাজের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করছে। প্রকল্পের অধীন বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য হিসেবে কর্মরত হানিন আল-সারসাবি জানিয়েছেন, এখানে দুর্লভ পত্রিকা, বই, সংবাদপত্র, নথি ও পাণ্ডুলিপি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের কাজ করা হয়। কয়েক ধাপে এসব কাজ সম্পন্ন হয়। প্রথমে এসব পাণ্ডুলিপির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাশাপাশি এসব সামগ্রীর কাগজের গুণমান, অম্লতা, কালির স্থিতিশীলতা এবং তা কার্বন বা লোহা হলে এর ধরন পরীক্ষা করে দেখা হয়। এরপর বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখা হয় এবং নরম ব্রাশ বা মেডিক্যাল ফরসেপ বা কাঁচি ইত্যাদি ব্যবহার করে পৃষ্ঠাগুলো সূক্ষ্মভাবে পরিষ্কার করা হয়। তারপর সেগুলো আর্কাইভে যুক্ত করা হয়।
এই প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের কাজটি খুবই গুরুত্ববাহী। বিশেষত আরব, মধ্যপ্রাচ্য তথা ইসলামী জগতের সমৃদ্ধ হেরিটেজ বা ঐতিহ্য এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই সংরক্ষিত হয়। আর দুর্লভ পাণ্ডুলিপি ও বইয়ের গুরুত্ব যত বেশি হবে তা সংরক্ষণের গুরুত্বও তত বেশি।
ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হানিন আল-আমসি জানান, এই প্রকল্পে পিএইচডি ও স্নাতকোত্তর ৯ জন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক তরুণী কাজ করছেন। তাঁদের আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ডিজিটাল পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু একের পর এক ইসরায়েলি বিধি-নিষেধের কারণে প্রকল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসলামপন্থী হামাস দল রাজনৈতিকভাবে খুব প্রভাবশালী। ২০০৬-০৭ সালের নির্বাচনে তারা জিতে এই উপত্যকায় স্বশাসন চালাতে শুরু করে। সেই থেকেই ইসরাইল এই উপত্যকাকে চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ইসরাইল এই রাজনৈতিক দল হামাসকে সন্ত্রাসবাদী বলে তকমা দিয়ে তাদের ওপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রেখেছে। এখানকার মানুষের কোনও স্বাধীনতা নেই। স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র সবকিছুই ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরাইল। উপত্যকার বাইরে ফিলিস্তিনের অন্য কোনও অঞ্চলে পর্যন্ত যাবার অধিকার তাদের নেই। বিদেশ ভ্রমণ বা চিকিৎসার জন্য ভিনদেশে যেতে হলে ইসরাইলি প্রশাসনের অনুমতি লাগে। এমনকী এদেরকে হজ পর্যন্ত করতে দেয় না ইসরাইল। সৌদি সরকারের অনুরোধে কিছু লোককে প্রতি বছর আমন্ত্রিত হিসেবে হজে যেতে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। গাজা উপত্যকাকে বলা হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত কারাগার। এরা দীর্ঘ সাড়ে ৭ দশক ধরে ইসরাইলি জুলুম, নিষ্পেষণের শিকার হয়ে নিজভূমে পরবাসী হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: