নবিজীর বাবা আব্দুল্লাহ যখন ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁর মা আমীনার বয়স মাত্র ২০ বছর। আমিনা ছিলেন সেই সময়ের আরবের অত্যন্ত সুন্দরী এবং অভিজাত উচ্চবংশীয়া। এছাড়াও তাঁর ছিল কবিতা আবৃত্তির অভিনব গুণ। আর তাঁর পুত-পবিত্র চরিত্রের সুখ্যাতি তো তৎকালীন মক্কার কারোই অজানা ছিল না!
তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের জন্য যে অনেক বড় বড় ঘর থেকে প্রস্তাব এসেছিল, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তিনি পুনরায় বিয়ের কথা চিন্তাই করলেন না। কেবল সন্তানের জন্যই একাকী বাঁচতে চাইলেন। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে এটা ছিল এক বিরল ঘটনা৷
নবিজীর দাদির নাম ফাতিমা আমর। পুত্রবধূ আমিনার সঙ্গে তাঁর একটি চমৎকার সম্পর্ক ছিল, বর্তমানের শাশুড়ি-বউমার মধ্যে যা কল্পনাই করা যায় না। ফলে স্বামী আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর তিনি বাপের বাড়িতে ফিরে গেলেন না, শ্বশুর-শাশুড়ির সংসারেই থেকে গেলেন৷
আমিনা এবং তাঁর শিশুপুত্র মুহাম্মাদের খরচ শ্বশুর আব্দুল মুত্তালিবই (নবিজীর দাদাজান) বহন করতেন। সংসার খরচের কোনো চিন্তা না থাকায় শিশুপুত্র মুহাম্মাদকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারতেন মা আমিনা। শৈশবের ৬ বছর দুধ মা হালিমার পাশাপাশি নিজের মায়ের অখণ্ড মনোযোগ লাভ করেন নবিজী।
একটি শিশুর মানসিক গঠন, ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে মূলত তার জীবনের প্রথম ছয় বছরে। নবিজী তাঁর জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে পার্থিব মাপকাঠিতে সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয় মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে পেয়েই বেড়ে উঠেছেন। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া প্রবল গুরুত্ব যে তাঁকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠতে সহায়তা করেছে।
সন্তানের যথাযথভাবে বেড়ে ওঠার প্রশ্নে এটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এ কারণেই জরিপে দেখা গেছে—কর্মজীবী মায়েদের অনুপস্থিতিতে কাজের বুয়ার কাছে বেড়ে ওঠা শিশুদের তুলনায় সরাসরি মায়ের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুরা অধিক আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকে।
মায়ের মৃত্যুর পর রাসূল (সা.) তাঁর দাদাজীর দায়িত্বে ন্যস্ত হন। এই ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং আত্মমর্যাদাবান পুরুষ। তাঁর জীবন নানা সাহসী উপাখ্যানে পূর্ণ। বহু বছর আগে মন্দীভূত হয়ে যাওয়া জম জম কূপ তাঁর হাতেই পুনরায় আবিষ্কৃত হয়েছিল।
একবার মরুভূমিতে আবদুল মুত্তালিবসহ কয়েকজন কুরাইশ সর্দার পানির অভাবে মরতে বসেছিলেন। সে সময় সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের কবর খুঁড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন—’মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ একটি ব্যর্থতা।’ পরে পানির খোঁজ পেয়ে যান তিনি।
এই যে পূর্বপুরুষের জীবনের সাহসী গল্পগাথা, এসব নিশ্চয় নবিজী শুনেছেন ছোটবেলাতেই! হয়ত আবদুল মুত্তালিব নিজেও গল্প করে থাকবেন নাতির কাছে। এসব গল্প তাঁকে সাহসে বলীয়ান হয়ে বেড়ে উঠতে সহায়তা করেছে। এ কারণেই একটি শিশুর যথাযোগ্য মানসিক বিকাশের জন্য বর্ধিত পরিবারের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
শিশুরা শুধু বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শেখে না। দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-মামা, খালা-ফুফু; এঁদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে তাদের জীবনে। আছে পারিবারিক ঐতিহ্যের এক সুদুরপ্রসারী প্রভাব৷ সন্তান প্রতিপালনে অভিভাবকদের এই দিকটাও মাথায় রাখতে হবে।
দাদাজীর মৃত্যুর পর রাসূল (সা.) দীর্ঘ প্রায় সতেরো বছর চাচা আবু তালিবের সংসারে ছিলেন। তাঁর এই চাচা খুব ধনী কোনো লোক ছিলেন না। উপরন্তু, তার পরিবারে ছয় ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী মিলে মোট আটজন সদস্য। রাসূল (সা.) নবম সদস্য হিসেবে যুক্ত হলেন চাচা আবু তালিবের সংসারে।
কিন্তু কেবল চাচার বোঝা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করলেন না তিনি৷ তার সমস্ত উট-ছাগল-দুম্বা চরানোর দায়িত্ব নবিজী নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। শুধু তা-ই নয়, মাঝে মধ্যে ব্যবসার কাজেও সাহায্য করতে লাগলেন। ব্যবসার প্রয়োজনে চাচার সঙ্গে চলে যেতেন দূর-দূরান্তের শহরে। নবিজীর তরুণ বয়সের এই প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ থেকে কি শিক্ষা নেবে না তরুণ ও যুবসমাজ? পিতার কাঁধে চেপে দিনের পর দিন পার করে দেবে?
পরবর্তী সময়েও এই চাচার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন রাসূল (সা.)। তাঁর যখন পঁচিশ বছর বয়স তখন খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহার সঙ্গে বিয়ে হয়। তারপর চাচার সংসার ছেড়ে নিজের সংসারে এসে উঠলেন। কিন্তু জীবনের কঠিন সময়ে আশ্রয় দেওয়া এই চাচাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে গেলেন না।
আবু তালিব ছা-পোষা মানুষ। অনেক সন্তানের খরচের ভার বহন করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। নবিজী আলী রাদিআল্লাহু আনহুকে নিজের সংসারে নিয়ে এলেন এবং তাঁর সমস্ত খরচের দায়ভার তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। শুধু তা-ই নয়, অপর চাচা আব্বাসকে অনুরোধ করলেন জাফরের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। আমরা কি তাঁর জীবন থেকে কৃতজ্ঞতা বোধের পাঠ শিখব না?
নবিজী আল্লাহর রাসূল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২৩ বছর। কিন্তু তাঁর জীবনের প্রথম ৪০ বছর ছিল এই ২৩ বছরের প্রস্তুতি-পর্ব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা নবুয়্যতের ২৩ বছর নিয়ে যত আলোচনা-পর্যালোচনা করি, পূর্বের ৪০ বছর নিয়ে ততটা করি না। অথচ সেখানেও রয়েছে আমাদের জন্য অনেক রকম শিক্ষার উপকরণ। শিশু, কিশোর, তরুণ এবং যুবক হিসেবে কেমন ছিলেন নবিজী; জানতে ইচ্ছে করে না?