মীযান ডেস্ক: ভূখণ্ডের আয়তনের নিরিখে লাতিন আমেরিকার সমান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এই অঞ্চলের দেশগুলোতে রয়েছে নানা ধরনের রাজনৈতিক পরিকাঠামো। এখানে প্রায় ৭০ কোটি মানুষ বসবাস করে। রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের কারণে এই অঞ্চলের সরলীকরণ অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। যেমন, ব্রুনাইয়ের স্বৈরাচারী সালতানাত থেকে লেনিনবাদী ভিয়েতনাম পর্যন্ত। এখানে আছে পূর্ব তিমুরের মতো ক্ষুদ্র গণতান্ত্রিক দেশও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ হল ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। দেশ তিনটির গণতন্ত্র এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত। তবে সার্বিকভাবে এই অঞ্চলের ১২টা দেশের গণতন্ত্র খুবই দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে খ্যাতনামা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় পতন ঘটে স্বৈরশাসক সুহার্তো জামানার অবসানের মধ্য দিয়ে। এরপর গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরে দেশটি। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যান স্লেটার লিখেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া প্রমাণ করেছে গণতন্ত্র আশ্চর্যজনক উপায়ে ও একটি আশ্চর্যজনক জায়গায় আবির্ভূত হতে পারে। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জোকো উইদোদোর নির্বাচন অনেকের কাছে সেই রূপান্তরের সিমেন্ট বলে মনে হয়েছিল।
পর্যবেক্ষকদের মতে, উইদোদো নিজেকে রাজনীতির বাইরের একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। যদিও দেশটির রাজনীতি এখনো ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা, রাজনীতিক ও সামরিক অভিজাতদের দ্বারা প্রভাবিত। এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে উইদোদোর দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে। তিনি একদিকে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশনকে অকার্যকর করে রেখেছেন। অন্যদিকে নতুন ফৌজদারি আইন দিয়ে নাগরিক অধিকার খর্ব করছেন। সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। তাছাড়া তিনি তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি প্রবোও সুবিয়ান্তোকে সমর্থন করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ রয়েছে। তবুও পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনিই জয়ী হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
থাইল্যান্ড দীর্ঘ সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে চলতি বছরের মে মাসের নির্বাচনে জয় পেয়েছে মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি। কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে এখনো আধিপত্য রয়েছে সামরিক বাহিনীর। এদিকে ৯ বছর নির্বাসনে থাকার পর দেশে ফিরেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্তা। এই থাকসিনের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভ্যুত্থান ঘটায় সেনাবাহিনী। এখন সেনাবাহিনীর সঙ্গেই সমঝোতা করছেন তিনি।
কম্বোডিয়ায় লাখ লাখ মানুষ গণতন্ত্রকে লালন করেন। কিন্তু বাস্তবে তার চিহ্ন খুব কমই দেখা যাচ্ছে। গত ২২ আগস্টের নির্বাচনে জয় পেয়েছেন দীর্ঘকাল ধরে শাসন করা হুন সান। তিনি এমন এক নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন যেখানে প্রধান বিরোধী দলই নিষিদ্ধ ছিল। বয়কট করেছিল বেশ কয়েকটি বিরোধী দল। পশ্চিমারা এই নির্বাচনকে প্রহসন আখ্যা দিয়ে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিলে পদত্যাগ করে ছেলে হুন মানেটকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসান হুন সান। কম্বোডিয়া বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার মতোই পারিবারিক স্বৈরতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে। তবে ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু হওয়া সত্ত্বেও দেশগুলোতে এখনো নাগরিক কণ্ঠস্বর স্বল্পমাত্রায় জাগ্রত।
এছাড়াও চীন, ভারত, মায়ানমার, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ নিয়েও নেতিবাচক চর্চা করেছে ইকোনোমিস্ট। চীনে বিরোধী দল বলে কিছু নেই, একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন চলে দেশটিতে। ভারতে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বজায় থাকলেও গণতন্ত্র এর ছদ্মবেশে স্বৈরাচার, একনায়তন্ত্র সবই রয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তানেও নাম কা ওয়াস্তে গণতন্ত্র আছে। বিরোধীদের দমন পীড়ন থেকে শুরু করে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করতে সবরকন হীন প্রয়াস চালায় ক্ষমতাসীনরা। মায়ানমারে দীর্ঘকাল সামরিকতন্ত্র থাকলেও আউন সাং সূচির হাত ধরে গণতন্ত্র ফিরলেও রোহিঙ্গা গণহত্যার পরবর্তীতে আবারও সেনা অভ্যুত্থান হয় এবং সামরিক শাসন ফিরে আসে।
আবার পশ্চিমারা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও এক্ষেত্রে তাদের দ্বিচারিতা প্রকট। যে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাদের অনুগত হয়, তারা সেই দেশকে গণতন্ত্রের মুকুট পরায়। যদিও বাস্তবে দেখা যায় ওই দেশ চরম অগণতান্ত্রিক। আবার যে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাদের প্রতিকূলে এগোতে চায়, সেই দেশের সরকারকে নানান অজুহাতে উৎখাত করে তারা। সেক্ষেত্রে সেনা অভ্যুত্থান এবং সামরিক শাসনকেও তারা গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দেয়।