মীযান ডেস্ক: সিরিয়ার বিদ্রোহীরা দেশটির উত্তর-পশ্চিমের ইদলিবে তাদের ঘাঁটি থেকে সরকার বিরোধী বিস্ময়কর অভিযান শুরুর পর দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশকের শাসন শেষে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন হয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও যা ভাবা যায়নি। এটাই সিরিয়ার জন্য টার্নিং পয়েন্ট। ২০০০ সালে পিতা হাফিজ আল আসাদের ইন্তেকালের পর ক্ষমতায় এসেছিলেন আসাদ এবং দুই যুগেরও বেশি সময় দেশ শাসন করেছেন। তাঁর বাবাও টানা প্রায় ৩০ বছর সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন ছিলেন। ২০১১ সালে বাশার আল আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন (আরব বসন্ত) নৃশংসভাবে দমনের জন্য তাকে সবসময়েই মনে রাখা হবে। ওই ঘটনাই সিরিয়াকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। এই যুদ্ধে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয় এবং শরণার্থীতে পরিণত হয় অন্তত ৬০ লাখ মানুষ।
রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতায় তিনি বিদ্রোহীদের দমন করে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। রাশিয়া তার বিমানবাহিনী ব্যবহার করেছিল, আর ইরান তার সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছিল সিরিয়ায়। পাশাপাশি লেবাননের হিজবুল্লাহ তাদের প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের মোতায়েন করেছিল সিরিয়ায়। সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে এবং হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় দুর্বল হয়ে পড়েন আসাদ।
এই বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। গত সপ্তাহে প্রথমে তারা কার্যত কোন প্রতিরোধ ছাড়াই আলেপ্পো দখল করে। এটি সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এর কয়েকদিন পরেই হামা ও হোমস শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলে নেয়। অন্যদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকেও এগিয়ে আসছিল বিদ্রোহীরা। ফলে অভিযানের এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আসাদ সরকার। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিদ্রোহী যোদ্ধারা রাজধানীতে প্রবেশ করে, যা ছিল আসাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।
তবে আসাদ পরিবারের সাড়ে পাঁচ দশকের শাসনের অবসান আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে বদলে দিতে যাচ্ছে। সিরিয়ায় এই পরিবর্তনের ফলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বড় ধরনের ধাক্কা খেল। আসাদের অধীনে সিরিয়া ছিল ইরানিদের সঙ্গে হিজবুল্লাহর যোগাযোগের অংশ। তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর জন্য এটা ছিল মূল পথ।
এইচটিএস-এর উৎস হল আল-কায়েদা। তারা গত কয়েক বছর ধরে জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে নিজেদের পরিচিত করানোর চেষ্টা করে আসছিল। তাদের সাম্প্রতিক বার্তাগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক ও সমঝোতামূলক সুর আছে। কিন্তু বহু মানুষই আছেন, যারা এতে আশ্বস্ত নন এবং তারা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন এই ভেবে যে, সরকার উৎখাতের পরই আসলে করণীয় ঠিক করবে বিদ্রোহীরা।
ইতিমধ্যেই সিরিয়ায় ঢুকে পড়েছে ইসরায়েলি ট্যাংক ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আইডিএফ। জানা গেছে, সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতনের পর ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমি থেকে সিরিয়ার ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে ইসরায়েলি ট্যাংক। সেখানে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটছে।
সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তোপের মুখে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ব্যক্তিগত বিমানে রবিবার রাশিয়া পালিয়ে যান। অল্প কিছুদিন আগে তাঁর স্ত্রী আসমা তিন সন্তানকে নিয়ে রাশিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের সাড়ে ৫ দশকের শাসনের অবসান হল। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশে সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে ঐতিহাসিক পালাবদল হয়েছে, যদিও এসবই ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার যেন দেড় দশক পর আরব বসন্ত আবার ফিরে এল, যা সিরিয়া দিয়ে শুরু হল। এবার তা প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।