ডা. মসিহুর রহমান
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য হল ইনসাফ কায়েম করা। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস হল তাওহীদ। তাওহীদ একত্ববাদের নাম। মহান স্রষ্টা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও গুণাবলীতে কোন সত্তার অংশী স্থাপন করা যাবেই না। যদি কেউ করে থাকে তাহলে ব্যক্তি অংশীবাদী বলে সাব্যস্ত হবে। অংশীবাদকে ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় ‘শিরক’। শিরক হল জঘন্যতম চিন্তা-ভাবনার নামান্তর।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন যখন মানুষ করে বা মানবগোষ্ঠী করে থাকে, তাদের দ্বারা সমাজে ইনসাফ কায়েম করার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। আল্লাহ সবচেয়ে সুবিচারক। আল্লাহ তার সৃষ্টির ওপর এতটাই দয়াশীল ও করুণাপ্রবণ যে, তাই তিনি কারোর ওপর কোনপ্রকার বাড়াবাড়ি করেন না। তিনি জুলুমকে নিজের ওপর অবৈধ করে নিয়েছেন। জুলুম বা অত্যাচার মানেই বে-ইনসাফি কার্যকলাপ।
আল্লাহর সৃষ্টিতে সর্বত্র ভারসাম্যপূর্ণতা রয়েছে। কোথাও কোনপ্রকার ভারসাম্যহীনতার লেশমাত্র নেই। আল্লাহ সবকিছুকেই ত্রুটি-মুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহপ্রদত্ত জীবনবিধানও ভারসাম্যপূর্ণ, সমতা রয়েছে। এখানে ইসলাম আল্লাহর দেওয়া মানবজাতির জন্য অনুগ্রহ স্বরূপ, অর্থাৎ রহমত। মানবজাতির জীবনে ইনসাফ কায়েমই হল ইসলামী জীবন বিধানের উদ্দেশ্য। মৌল বিশ্বাস, চিন্তা-ভাবনা, জীবনবিধানের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে ইনসাফ কায়েম করা যায় না।
তাওহীদি ধর্ম হিসেবে ইসলাম পৃথিবীতে ইনসাফ কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইনসাফ হল শর্তহীন। শর্তহীন হল এই অর্থে যে- কোন ধর্ম, বর্ণ, বংশ, গোত্র, জাতি, ভৌগোলিকতার ভিত্তিতে ইনসাফ করা বা না-করার বিষয়টি এখানে পরিত্যাজ্য। বর্ণ, বংশ, ধর্ম, জাতি, এলাকা, অঞ্চল বা ভৌগোলিকতার অন্তর্ভুক্ত সকল মানুষকে ইনসাফ দিতে হবে। ইনসাফ প্রত্যেকের লাভ করা তার জন্মগত অধিকার।
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার এই অনিন্দ্য সুন্দর বৈশিষ্ট্য ইসলামী জীবনবিধানকে এত মহীয়ান করেছে। মুশকিল হল মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতি কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা ইসলামী সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্রব্যবস্থার এই আদর্শ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক টানাপড়েনে ইনসাফ সবার ওপর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং দেখা গেছে, মুসলিম জাতীয়তাবাদী পলিটিক্স অন্যান্যদের মতো করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুকরণ করতে গিয়ে ইনসাফের গলায় ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। ফলত অমুসলিম জনগণ ইসলামের ইনসাফ-প্রিয় রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারার আলোকচ্ছটাকে বুঝে উঠতে পারেনি। ইসলাম আর মুসলিমদের ব্যবহারিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে পৃথক পৃথকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি।
অমুসলিমদের কাছে ইসলামের সামাজিক সুবিচারের ধারণাকে প্রামাণ্য দলিল আকারে উপস্থাপন করতে হবে। মুসলিমদের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে সংশোধন করতে হবে। কোন দেশে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে পাশ্চাত্য ধাঁচের রাজনৈতিক চর্চা ও তার থেকে উদ্ভূত সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চিন্তা-ভাবনার ফলে সৃষ্ট টানাপড়েনকে বুঝতে হবে। মুসলিমদের ভুলকে ভুল হিসেবে সাব্যস্ত করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে যে সকল ইসলামপন্থী দল ইসলামের সামাজিক সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতাকে এই সরেজমিনে প্রতিষ্ঠা করতে দায়িত্বশীল, তাদের কার্যকলাপকে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সঠিক মূল্যায়ন করা একান্ত দরকার। ইসলামের এক সোনালি অতীত ইতিহাস আছে। সুবিচারমূলক ও ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র নির্মাণের বাস্তব নমুনা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সময়ে দুনিয়া অবলোকন করেছে। এই ইতিহাসকে কেউ কোনমতে চেষ্টা করেও অস্বীকার করতে পারবে না। মানুষদের বিভ্রান্ত করে পার পাবে না। কেননা, ইতিহাস নিরপেক্ষ। দলিল-প্রমাণ ছাড়া ইতিহাস হয় না। নৈবর্ক্তিক ইতিহাস চর্চার কাজ হল ঐতিহাসিকদের।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর দুনিয়া থেকে বিদায়ের পর তাঁর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সত্যানুসারী খলিফারা সেই আদর্শের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ফারুখ থেকে শুরু করে হযরত আলী পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহত ছিল। সাম্প্রদায়িক সমস্যার উদ্ভব হয়নি তাঁদের শাসনামলে। বর্ণ, ধর্ম ও জাতীয়তার ভিত্তিতে ইনসাফের বিষয়টির রাষ্ট্রীয় অনুশীলন হয়নি। অর্থাৎ ইনসাফ শর্তহীন ছিল। সেই ইতিহাস হল পৃথিবীবাসীর জন্য মাইলফলক।
আজকের যুগে লোকেরা সমাজতন্ত্র, পশ্চিমা জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর চর্চা করে থাকে। এইসব নীতি ও চিন্তা-ভাবনার ভিত্তিতে কোন দল আন্দোলন করলে বা রাজনৈতিক বিপ্লব করতে চাইলে সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা জনগণ কতটা পাবে, সেই বিষয়ে অপপ্রচার, প্রোপাগান্ডা অতটা হয় না। কিন্তু কোন আদর্শপরায়ণ ইসলামপন্থী দল রাজনৈতিক বিপ্লবে অংশগ্রহণ করলেই মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবার জুজু দেখানো হয়। অথচ আধুনিক পাশ্চাত্য মতবাদগুলি গত কয়েক শতক ধরে গোটা দুনিয়াকে নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে বিষময় ফল তৈরি করেছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মানুষ। গণতন্ত্রে মানুষের অধিকার কীভাবে পদদলিত হচ্ছে, তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে। অনৈতিক আচরণের ব্যাপকতা ক্রম প্রসারমান। সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনার শিকার রাষ্ট্রের কর্মকর্তা থেকে আমজনতা। সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দৈন্যদশা প্রকটমান। তার ফলে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। সমাজতন্ত্রের পথ বেয়ে কমিউনিজমে উত্তরণ ব্যর্থ হয়ে গেল, অধরা রয়ে গেল।
ইসলামের সোনালি অতীত যখন রয়েছে, আর প্র্যাকটিক্যালি যখন ইনসাফপূর্ণ সমাজের রূপরেখা বিশ্ব দেখেছে, তখন দুনিয়া কেন ইসলামের অনুসরণে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগতে থাকবে। আসলে কয়েকটি স্বার্থান্বেষী দল, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীরা এবং অংশীবাদী ধর্মীয় নেতারা মানুষদের নিজ নিজ স্বার্থেই ও আধিপত্যকে ধরে রাখতে ইসলাম সম্পর্কে ভুল প্রচার করছে।
মুসলিম দেশগুলির উচিত ইসলামের ভিত্তিতে সামাজিক সুবিচারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের সত্যকে তুলে ধরা। এটা তাদের বিশ্বাসগত দায়িত্ব। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে বিবেকের পাহারাদার ও জনগণের পাহারাদার দল, নেতা, কর্মী, রাষ্ট্রীয় কর্ণধারগণ, কর্মচারীরা হয়ে থাকেন। আল্লাহর প্রতি জবাবদিহীর তীব্র চেতনাকে তাদের ইনসাফ-প্রিয় করে তোলে। ন্যায়, ইনসাফ তাদের মজ্জাগত তাই হয়ে যায়।