কুরআন শিক্ষা ও চর্চা না করার পরিণতি

আলী ওসমান শেফায়েত
আমাদের অনেকেই সহিহ-শুদ্ধ করে কুরআন পড়তে না পারলেও কুরআনের জন্য আমাদের অন্তরে রয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। এই সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় আমাদের বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই। নামায পড়ার জন্য কিছু সূরা মুখস্ত করা, মৃত পরিজনের জন্য ইসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরআন-খানি করা, কেউ মারা গেলে লাশের পাশে গোল করে ঘিরে বসে কুরআন তিলাওয়াত করা—এসবের জন্যই কি পবিত্র কুরআন মজীদ নাযিল হয়েছে? কুরআন কি শুধুমাত্র মৃত ব্যক্তির জন্য নাযিল হয়েছে? নাকি জীবিত মানুষের জন্য? আসুন ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করি। যারা দুনিয়ার জীবনে দুনিয়া সংক্রান্ত সবকিছু আয়ত্ত করলেও কুরআনের শিক্ষা অর্জন করেনি এবং এর শিক্ষা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি, তাদের পরিণাম-পরিণতি সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের ছত্রে-ছত্রে রয়েছে বহু হুঁশিয়ারি বার্তা।

রাসূলের (সা.) অভিযোগ পেশ: কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থায় আল্লাহ তাআলার অনুমতি সাপেক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মাতের জন্য শাফায়াত চাইবেন। কিন্তু যারা কুরআন শিক্ষা করেনি, কুরআনের যেসব হক রয়েছে তা আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন নবী (সা.) তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ পেশ করবেন। কুরআনে এসেছে: আর রাসূল বলবেন, হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে। (সূরা ফুরকান: ৩০)। ইবনে কাসীর (র.) বলেন, কুরআন না পড়া, সেই অনুসারে আমল না করা, তা থেকে হেদায়াত গ্রহণ না করা, এ সবই কুরআন পরিত্যাগ করার শামিল।

কিয়ামতের দিন অন্ধ হয়ে উঠবে: যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা থেকে থেকে বিমুখ হয়ে থাকলো, সে কতই না দুর্ভাগা! আল কুরআনে বলা হয়েছে, আর যে আমার যিকর (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, নিশ্চয় তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি কিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, অনুরূপভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অতঃপর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। (সূরা ত্বহা: ১২৪-১২৬)।

বোবা ও বধির অবস্থায় উঠবে: সবচেয়ে বড় হেদায়েত আল-কুরআন প্রত্যাখ্যানকারীদের কবর হবে সংকীর্ণ, যার দরুন তাদের দেহের পাঁজরগুলো বাঁকা হয়ে যাবে। অবশেষে কিয়ামতের দিন বোবা ও বধির হয়ে উঠবে। আল কুরআনে বলা হয়েছে: আমি কিয়ামতের দিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ অবস্থায়, বোবা অবস্থায়, বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখন জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরও বাড়িয়ে দেবো। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৯৭)।

গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া: কুরআন শিক্ষা না করা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শামিল। কুরআনে বলা হয়েছে, কুরআনের মহাসত্য জানার পরেও যারা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে না, চোখ দিয়ে দেখে না, কান দিয়ে শোনে না – এরা চতুস্পদ জন্তুর ন্যায়; বরং এরা তাদের চেয়েও আরো অধম ও নিকৃষ্ট, এরাই হল গাফেল। (সূরা আরাফ: ১৭৯)।

কুরআন দলিল হিসেবে আসবে: কুরআন শিক্ষা থেকে বিরত থাকার কারণে কুরআন তার বিপক্ষের দলিল হিসেবে উপস্থিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন: কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে দলীল হবে। (সহিহ মুসলিম- ২২৩ (৪২২); মিশকাত- ২৮১)।

জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে: জাহান্নামের মতো ভয়াবহ কঠিন জায়গা আর নেই। কুরআন শিক্ষা না করার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে। নবী কারীম (সা.) বলেন, কুরআন সুপারিশকারী এবং তাঁর সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনকে সামনে রেখে তাঁর অনুসরণ করবে, কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি একে নিজ পশ্চাতে রেখে দিবে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। – (সহিহ ইবনে হিব্বান- ১২৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক- ৬০১০; শু‘আবুল ঈমান- ১৮৫৫; আল মু‘জামুল কাবীর- ৮৬৫৫; মুসান্নাফ ইবনু আবি শায়বাহ- ৩০০৫৪; সিলসিলাতুল আহাদিসুস সহিহা- ২০১৯)।

আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে: কুরআন শিক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন না করলে এ বিষয়ে আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, নিশ্চয় এ কুরআন তোমার জন্য এবং তোমার কওমের জন্য একটি মর্যাদাবান উপদেশ। আর অচিরেই তোমাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সূরা যুখরুফ: ৪৪)
সবশেষে যে কথা না বললেই নয়, তা হল, কুরআন আর পাঁচটা ধর্মগ্রন্থের মতো নয়। এটা সমগ্র মানব জতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এই কুরআনকে মাতৃভাষায় বোঝার, উপলব্ধি করার এবং সেই মোতাবেক আমল করার চেষ্টা করতে হবে। তবেই মুসলিম হিসেবে কামিয়াব হওয়া যাবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কুরআন বোঝার জন্য সহজ করে দিন এবং আমল করার তাওফীক দিন। আমীন।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: