মো: তাহেরুল হক
১) পৃথিবীতে মানুষের জীবন এক বিচিত্রময় ও গতিময়ভাবে চলে। একদিন যখন এই গতি হবে স্তব্ধ, তখন পৃথিবীর সব আশা-ভরসা আর থাকবে না। বরং জীবনের প্রতিটি কাজের জন্য সূক্ষ্ম হিসাবের সামনে দাঁড় করানো হবে। তখন বোঝা যাবে কে সফল, আর কে ব্যর্থ। প্রথম মানুষ আদম (আ.) থেকে মানব জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস ও নীতিমালা কুরআন সংক্ষিপ্তভাবে শুনিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ছয়টি জাতির মারাত্মক পরিণতি ঘটে তারা সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এটা একটা ইতিহাস। এর থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য কুরআন আমাদেরকে সচেতন হতে বলে।
মানুষ আজ আছে, কাল থাকবে না। মানব সমাজ এক সময় বিপুল পরিমাণে উন্নতি সাধন করে, কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে তার বিলীন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতন কেন হয়, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানবীয় আচরণ কেমন থাকে এবং জাতির উত্থান-পতনের মূলে কি কার্যকর ভূমিকা রাখে? বাইবেলের নতুন পুরাতন (ইন্জিল) বা তাওরাত ও কুরআনের মাধ্যমে মানবজাতির উত্থান-পতনে সভ্যতার একটা প্রেক্ষাপট পেয়ে থাকি।
নানা কারণে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু এক একটা জাতি যখন সমূলে বিনষ্ট হয়, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তার কারণ আমাদের সামনে থাকলে পরবর্তী সমাজ জীবন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এভাবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ছয়টি জাতি ধ্বংস হয়েছে। কুরআন পৃথিবীর নবী-রাসূলদের উল্লেখ করেছে। তার মধ্যে বিভিন্ন যুগের ছয়টি জাতির ধ্বংসপ্রাপ্তির ইতিহাস কারণ ও প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছে। যেমন নূহ নবীর প্লাবন, দুর্ধর্ষ আদ ও সামুদ জাতির করুণ পরিণতি, লূত নবীর সময়ের সমকামী সমাজের ধ্বংসলীলায় ‘ডেড সী’-র অবস্থান, হযরত শোআয়েব (আ.)-এর সমকালে মানুষের চারিত্রিক অধঃপতনে বীভৎস দাবানল এবং মূসা নবীর দুশমন ফেরাউনের অহংকার নীলনদে সমূলে বিনাশ হওয়া কী কম শিক্ষণীয় ছিল না!
এবার এই ছয়টি ইতিহাস-খ্যাত জাতির উত্থান-পতনের কার্যকারণ সম্পর্ক কেমন ছিল, কুরআনের আয়নায় তার মূল্যায়ন করা যেতে পারে। কুরআন বলে, আল্লাহর ক্ষমতার বিস্ময়কর নিদর্শন স্মরণ করো (৭: ৬৯) এবং আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মাধ্যমে উপদেশ গ্রহণ করো (১০: ৭১)। আজকের মুসলিম সমাজ যেভাবে জীবনযাপন করছে এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহের যেসব অন্যায়-অপরাধের কারণে ধ্বংস হতে হয়েছে তার সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জস্য বিরাজ করছে। আজকের মুসলিমদের একটা বড় অংশ কুরআনের ইতিহাস চর্চা করে না, নিজেদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ভয়াবহ ধ্বংসের কারণ মূল্যায়ন করে না। যেন আত্মভোলা ও স্বেচ্ছাচারিতাপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অথচ আল্লাহ সতর্ক করেছেন যে, তোমরা আত্মভোলা জাতির ন্যায় হয়ো না (৫৯: ১৯)।
তাহলে অহংকারী, আত্মভোলা ছয়টি জাতির বিবরণ দেখা যাক:
১) নূহ নবীর সময়: হযরত আদম (আ.)-এর দশম পুরুষ হযরত নূহ (আ.)। কুরআনের ২৮টি সূরার ৮৯টি আয়াতের বিবরণে জানা যায় যে, তিনি জনগণকে ৯৫০ বছর আল্লাহমুখী হওয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে আবেদন জানিয়েও মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভিন্ন খুব একটা সফলতা পাননি। তাফসীরে মাযহারীর মতে তিনি আদম (আ.)-এর ২৮৫৬ বছর পর জন্মেছেন। তাঁর ঔরসজআত আদি বংশ চারটি। শাম, হাম, ইয়াফিস ও য়্যাম (কেনআন)। বেঁচে ছিলেন ১৪৫০ বছর। ইরাকের উত্তর-পূর্বের মুসেল এলাকায় তাঁর আগমন ঘটে। বরাবরই তিনি তিনটি মৌলিক বিষয়ে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। (১) আল্লাহর একত্ব অর্থাৎ তিনি ভিন্ন মানুষের জন্য কোন উপাস্য নেই। সব কিছু তিনিই নির্ভর। পৃথিবী মানুষের জন্য কর্মক্ষেত্র এবং পরীক্ষাগার। যেমন কর্ম করবে, পরকালে তেমন ফল ভোগ করতে হবে। কিন্তু মানুষের প্রবৃত্তি, অহংবোধ, তাকে আল্লাহ-ভোলা করে রাখে। তার থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। (২) মানুষের এই জীবন চূড়ান্ত নয়। মৃত্যু আছে। অতঃপর পরকালীন জীবন নিশ্চিত আছে। সেখানে পার্থিবের প্রত্যেক কাজের নিখুঁত জবাব দিতে হবে। পৃথিবী নয়; বরং সেই সফলতাই আসল। (৩) এই জাতীয় ভাবনা এবং উদ্দীপনা কেবল নবী-রাসূলগণ থেকে পাওয়া যায়।
এটাই ছিল নূহ (আ.)-এর দাওয়াত ও আবেদনের মূল কথা। কিন্তু তাঁর সমাজের মানুষ তাঁকে বলেছে: মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ, কল্পকথার নায়ক। তিনি আমাদের মতো একজন মানুষ ভিন্ন কিছু নয়। সুতরাং তাকে আমাদের সমাজের ঊর্ধ্বে মনে করার কোনো কারণ নেই। তারা সম্পূর্ণভাবে হযরত নূহের কথা প্রত্যাখ্যান করে এবং তারা আজকের সমাজের বুজুর্গ-প্রীতি ও মুরুব্বী-প্রীতির ন্যায় বলতে লাগল আমরা কোন অবস্থায় ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসর নামের দেব দেবীকে ছাড়ব না। এই দেব-দেবী আসলে তাদের পূর্বকালের সমাজপতি ও বড়রা। তাদের কথাকে হযরত নূহ থেকে তারা বড় বলে জানত। এভাবে তারা নূহকে প্রত্যাখ্যান করে। অতঃপর আল্লাহ তাদের জন্য শেষ ব্যবস্থা করলেন।
আল্লাহ তাকে বললেন: তুমি একটি নৌকো বানাও এবং যারা যুলুম করেছে, তাদের ব্যাপারে তুমি আমার কাছে কিছু বলো না। নিশ্চয়ই তারা নিমজ্জিত হবে। এরপর তিনি নৌকা বানাতে থাকলেন। যখন তার জাতির নিকৃষ্ট স্থানীয় লোকেরা সেখান দিয়ে যাওয়া-আসা করত। তাদেরকে দেখে হাসাহাসি করত। তিনি বললেন, তোমরা জানতে পারবে কীভাবে কার উপর আযাব আসবে এবং কারা দুনিয়াতে অপমানিত হবে। এক সময় নবীর কথা সত্য প্রমাণ হল এবং মারাত্মক আকার নিয়ে সমগ্র দেশজুড়ে বন্যা এল। এভাবে নূহের জাতি সম্পূর্ণভাবে প্লাবনে ডুবে নিঃশেষ হয়ে গেল।
সমাজের অপরাধ কী ছিল?
(১) নবীর কথাকে মিথ্যা মনে করত। (২) তাঁর বর্ণনা মতে, পরকালকে অস্বীকার করত। (৩) পিতৃ পুরুষের রীতিনীতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করত। (৪) তথাকথিত বড়দের বা তাদের বিশ্বাস মতে – বুযর্গদের আচরণকেই প্রাধান্য দিত। ফলে অনিবার্য ধ্বংসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
(২) হূদ ও আ’দ জাতি:
নূহের পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যের হেজায ও য়্যামামার মধ্যবর্তী এলাকার নবী হিসাবে আসেন
‘হূদ’ নামক নবী। সে সময় বলিষ্ঠ দুর্ধর্ষ জাতি হিসাবে পরিচিত ছিল ‘ইরাম’ নামক জাতির অন্যতম গোষ্ঠী ‘আ’দ’ জাতি। কুরআনের ১৪ টি সূরায় তাদের বিবরণ আছে। তাদের শারীরিক সক্ষমতার পরিচয় কুরআনে উল্লেখ আছে। (৭: ৬৯)
হূদ (আ.)-এর দাওয়াতের মূল কথা ছিল:
১) এক আল্লাহ ভিন্ন কেউ তো উপাস্য নেই। কেবল তাঁর কথা মতো জীবনযাপন করা উচিত।
২) আমি নবী হিসাবে তোমাদের থেকে কোনো পারিশ্রমিক ও বিনিময় আশা করি না; বরং তোমাদের মঙ্গল কামনায় একজন উপদেশদাতা মাত্র।
৩) মৃত্যুর পর সব মানুষকে আল্লাহর দরবারে পার্থিবের সকল কাজের পূর্ণ হিসাব দিতে হবে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো, আমি তাঁর নবী, আমাকে অনুসরণ করো, তোমাদের কল্যাণ হবে।
সমাজের প্রত্যাখান:
আ’দ জাতির লোকেরা তাদের নবীকে মনে করল, (১) অসামাজিক। নির্বোধ। মিথ্যুক।
২) তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মকে নস্যাৎ করতে তৎপর। কাজেই সর্বতোভাবে তাকে না মানার জন্য জোটবদ্ধ হয়ে বিরোধিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ধ্বংসের আবরণ:
নির্ধারিত সময়ে তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ ও আযাব এসে গেল। আল্লাহ মুষ্টিমেয় ঈমানদারদের বাঁচিয়ে অমান্যকারীদের নির্মূল করে দিলেন (৭: ৭১-৭২)। আ’দ জাতির ধ্বংসের বিবরণ এভাবে বর্ণিত হয়েছে:
১) তাদের উপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণকারী মেঘমালা পাঠালেন। (১১: ৫২)
২) তারা কি দেখেনি, তাদের আগে আমি এমন বহু জাতিকে বিনাশ করে দিয়েছি, যাদের আমি পৃথিবীতে এমন প্রতিষ্ঠা দান করেছিলাম, যা তোমাদেরও দান করিনি। আকাশ থেকে তাদের উপর আমি প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। আবার তাদের মাটির নিচ থেকে আমি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে দিয়েছি, অতঃপর তাদের পাপের কারণে আমি তাদের চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছি। (৭: ৬)
৩) হুদ তার আল্লাহকে বললো: এরা যেহেতু আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তাই আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আল্লাহ বললেন – অচিরেই এরা (নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য) অনুতপ্ত হবে। অতঃপর একদিন মহাতাণ্ডব এসে তাদের উপর আঘাত হানল এবং আমি তাদের সবাইকে তরঙ্গতাড়িত আবর্জনার স্তূপসদৃশ বস্তুতে পরিণত করে দিলাম; যালেম সম্প্রদায়ের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হয়। (২৩: ৩৯-৪১)
(৩) ছালেহ এবং ছামূদ জাতি:
এই জাতি আরবের মদীনা থেকে উত্তর-পশ্চিম এলাকার হিজর এলাকা। তাবুক ও সিরিয়ার পথে আল উলার পর মাদায়েনে ছালেহ বলে চিহ্নিত। যারা উপত্যকায় পাথর কেটে গৃহ নির্মাণ করত। (আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেন: তোমরা পর্বতগাত্র খনন করে প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করো, জাঁকজমকের সঙ্গে জীবন যাপন করো। নরম মাটিতেও অট্টালিকা নির্মাণ করো। (৭: ৭৪) জাতি হিসাবে তারা ছিল বিত্তসম্পন্ন, শক্তিশালী ও বীর জাতি। স্থাপত্য বিদ্যায় ছিল পারদর্শী। তাদের সমাজের জন্য এসেছিলেন ‘ছালেহ’ নামক এক নবী। এক আল্লাহর আনুগত্য এবং সমাজের শের্ক ও মূর্তিপূজার প্রতিবাদ করতেন। সমাজের মানুষ আগের ন্যায় নবীর বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, তাঁর সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া-র মতো সকল রকম চক্রান্ত করে। এভাবে হরেক রকমের অত্যাচার ও সীমা লঙ্ঘণমূলক কাজের জন্য নবী তাদেরকে সতর্ক বললেন- তোমরা নিজ নিজ ঘরে মাত্র তিনদিন অপেক্ষা করো, আল্লাহর আযাব আসবে। অতঃপর যথাসময়ে বিকট মহানাদ (শব্দ) তাদেরকে করলো আঘাত। ফলে তারা তাদের ঘরসমূহেই মুখ থুবড়ে পড়ে রইল। মনে হল যেন সেখানে তারা কোনদিন বসবাস করেনি। মনে রেখ- ছামুদ জাতি তাদের মালিককে অস্বীকার করেছিল, অতঃপর ছামুদ জাতির জন্য এই ধ্বংস নির্ধারিত ছিল। (১১: ৬৫-৬৮)