রাকিব হাসনাত
মুসলমান প্রধান দেশগুলো সবসময় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন এবং সংহতি জানায়। অথচ বড় ধরনের সংকট দেখা দিলে মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় না। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইজরায়েলের বিপক্ষে এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো ভূমিকা নিতে পারে না। এবারও তাই দেখা যাচ্ছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে টানা ২০ দিন ধরে গাজায় নিরবচ্ছিন্ন প্রাণঘাতী বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। যাতে অন্তত হাজার পাঁচেক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের একটা বড় অংশই নারী এবং শিশু।
এমতাবস্থায় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স-সহ প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো খুল্লমখুল্লা ইজরায়েলের সর্বাত্মক সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। এর বিপরীতে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে ইরান এবং তুরস্ক ছাড়া আর কোন দেশকেই কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না। কোন কোন মুসলিম দেশের প্রতিক্রিয়া একেবারেই নখদন্তহীন, কেউ কেউ কুলুপ এঁটেছে। সব মিলিয়ে বলা যায় ৫৭টা মুসলিম প্রধান দেশ কার্যত নীরব, নির্বিকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলিম উম্মাহ ফিলিস্তিনের পক্ষে এককাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে ওইসব দেশের সরকার শক্ত অবস্থান নিতে অপারগ। আবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া বা শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হল পশ্চিমাদের কূটনৈতিক অবস্থান। ইজরায়েল একক প্রতিপক্ষ হলে হয়ত পরিস্থিতি অন্যরকম হত।
এবার হামাস এমন সময় হামলা চালিয়েছে যখন আমেরিকার তত্ত্বাবধানে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে কাজ করছিল সৌদি আরব ও ইজরায়েল। গতবছর সেপ্টেম্বরে এই নিয়ে সৌদি গিয়ে কথা বলেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন কর্মকর্তারাও। ইতিমধ্যেই ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাই তারা হামাসের হামলার সমালোচনা করেছে। বিবৃতিতে ইসরায়েলি নাগরিকদের জিম্মি করার বিষয়টিও এসেছে। কিন্তু ইজরায়েলের প্রাণঘাতী হামলার বিষয়টি সেখানে উল্লেখ করা হয়নি।
আগামী বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই সৌদি ও ইজরায়েলের মধ্যে সমঝোতা বা চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে কৃতিত্ব নিতে চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে সম্প্রতি ইজরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরুর পর সেই প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত করেছে সৌদি। তাদের সর্বোচ্চ যুবরাজ বিন সালমান বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার রক্ষা, তাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা এবং স্থায়ী শান্তির জন্য সবসময় তাদের পাশে থাকবে।
কাতার বরাবরই ইজরায়েলের বিরোধী। তারা ফিলিস্তিনের জন্য পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের আগের ভূখণ্ডকে সমর্থন করে। বাহরাইন হামাসের হামলার সমালোচনা করেছে। আর কুয়েত এবং ওমানের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটাই কৌশলী।
অন্যদিকে ইজরায়েলের সঙ্গে ১৯৮০ সালে চুক্তি করা মিশর উভয় পক্ষকে সংযত হতে বলেছে। সিরিয়া অবশ্য হামাসের হামলাকে বড় অর্জন বলেছে। হুতি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনও হামাসকে সমর্থন দিয়েছে। আর আরব বিশ্বের বাইরে অনেকটা একই সুরে কথা বলেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতান্ত্রিক সরকার মুসলিম বিশ্বে খুবই কম। তাই এসব দেশগুলোর সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমাদের ওপর নির্ভর করতে হয় বলে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাদের নেই। আবার ফিলিস্তিনে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন পিএলও, গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাসের পাশাপাশি আরেক সংগঠন হেজবুল্লাহকেও বিভিন্ন প্রভাবশালী মুসলিম দেশ সমর্থন দিয়ে থাকে বলে প্রচার আছে। যেমন হামাস ইরান-সমর্থিত বলে বর্ণনা করে পশ্চিমারা।
নিজেদের অস্তিত্বের তাগিদে আরব আমিরাত ও সৌদি আরব এবং তাদের অনুসারী অন্যান্য আরব দেশগুলো ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে। তাই তাদের পক্ষে ইজরায়েলকে ঘাঁটানো বা চটানো সম্ভব নয়। আর এটাই মূলত ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে দুর্বল করছে। আরবদের এই পরজীবিতার কারণ মূলত, আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বা নির্বাচনের বালাই নেই। বংশ পরম্পরায় সব গদি দখল করে রাজা বাদশাহ হয়ে থাকে বা রয়েছে। তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে মরিয়া। গণতান্ত্রিকভাবে ভোট করে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষপাতী তারা নয়। তাই একবিংশ শতাব্দীতেও তাদের গদি রক্ষার স্বার্থে ইজরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা বা ভারসাম্য রক্ষা করে চলা তাদের জন্য জরুরি ও বাধ্যতামূলক। যদিও এইসব দেশের জনগণ কিন্তু একচেটিয়া ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে। কিন্তু তাদের মতামতের কোনও মূল্য নেই। সরকার জনমতকে গুরুত্ব দেয় না। কোনও ইস্যুতে জনমত গড়ে উঠতে তারা দেয় না।
মুসলিম বিশ্বে ইরান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ছাড়া আর কোনও দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং সরকার বদলায় না। এর মধ্যে সবথেকে বেশি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হল ইরান এবং তুরস্ক। তাই তারা আমেরিকা ও ইজরায়েলের যুদ্ধবাজ নীতির কট্টর সমালোচনা করতে পারে। কারণ, এই দুই দেশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষার মতো দিক থেকে অনেকখানি স্বনির্ভর। তাই সব ব্যাপারে তারা পশ্চিমাদের ওপর নির্ভর করে না। তুরস্ক এবং ইরান জানে, তাদের দেশে গণতন্ত্র আছে। তাই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমা বা ইরায়েলের সঙ্গে সমঝোতার প্রয়োজন নেই। সর্বোপরি ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবার পর ইজরায়েল বড্ড বেশি মাইলেজ পেয়ে যায়। ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে ট্রাম্প কোনওকিছুর তোয়াক্কা না করে জেরুজালেম এবং গোলান মালভূমিকে ইজরায়েলের হাতে তুলে দিয়ে যান। সেই থেকেই নেতানিয়াহু এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। আর ইজরায়েলের সবথেকে বড় হাতিয়ার হল ইহুদি লবি এত বেশি শক্তিশালী যে, আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের ওপর এই লবি ভীষণ প্রভাব রাখতে সক্ষম।
