একের পর এক শান্তি চুক্তির পরেও ফিলিস্তিনের সংকট কেন ঘুচল না? যুগ যুগ ধরে অশান্তির জন্য দায়ী কে?

মীযান ডেস্ক: নরওয়ের রাজধানী অসলোতে ফিলিস্তিনি এবং ইজরায়েলিদের মধ্যে এক শান্তি চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। মধ্যস্থতা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন। ওই চুক্তির জন্য পিএলও নেতা তথা ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রাবিন নোবেল শান্তি পুরষ্কারও পেয়েছিলেন।

ওই চুক্তিতে উভয় পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছিল- ফিলিস্তিনিরা স্বশাসনের আংশিক অধিকার পাবে এবং ইসরায়েল প্রথমে পশ্চিম তীরের জেরিকো এবং তারপর গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। পরিবর্তে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের বৈধতা স্বীকার করে নেবে পিএলও। ফিলিস্তিন সেই চুক্তি মানলেও ইজরায়েল তা মানেনি। ২০০৬ সালে গাজা উপত্যকায় নির্বাচনে জিতে হামাস স্বশাসন পরিচালনা করলে ইজরায়েল গাজা উপত্যকাকে তিনদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলে হামাসের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে এবং একইসঙ্গে পিএলওকে উসকাতে থাকে। এবং হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

অসলো শান্তি চুক্তি হলেও কয়েকটি বিষয়ে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল কখনও সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি এবং এগুলোকে কেন্দ্র করেই বারবার সংঘাত সহিংসতা হয়েছে।

১৯৬৭ সালে যুদ্ধের সময় ইসরায়েল পূর্ব জেরুসালেম, পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা দখল করেছিল। এরপর বছরের পর বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। দখলকৃত এলাকা থেকে ইসরায়েলকে সরে আসার জন্য ২৪২টি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রসংঘের সর্বোচ্চ সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদ। কিন্তু সবেতেই সই করলেও কোনওটাই মানেনি ইজরায়েল। প্রতিবার মাঝপেথ তারাই চুক্তি বা প্রস্তাব ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে।

নরওয়ের রাজধানী অসলোতে ১৯৯৩ সালে অত্যন্ত গোপনে এক আপোষ মীমাংসার মধ্য দিয়ে সমঝোতায় স্বাক্ষর করেছিলো দুই পক্ষ, যা অসলো চুক্তি নামে পরিচিতি পেয়েছিলো। কিন্তু সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস তখনি এ চুক্তির বিরোধিতা করেছিলো। এ চুক্তিও কাঙ্ক্ষিত সফলতা এনে দিতে পারেনি বরং উভয়পক্ষ একে অপরকে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে প্রায়শই হামলা-পাল্টা হামলায় লিপ্ত হয়েছে।

তবে ওই চুক্তির আওতায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছিলো এবং কথা ছিলো পরবর্তী পাঁচ বছর এ কর্তৃপক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে সংঘাত নিরসনে আলোচনা চালিয়ে যাবে ও অন্য বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান করবে। পরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের জায়গায় একটি নির্বাচিত সরকার সেখানকার ক্ষমতায় আসার কথা, যারা পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা মিলিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। ফিলিস্তিনিদের দাবি ছিল, তাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুসালেম, যদিও এই বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কখনো সমঝোতা হয়নি।

বাস্তবতা হলো তিন দশক পরে এসেও এখন সেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ রয়েই গেছে- যার নেতৃত্বে আছেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। কিন্তু ফিলিস্তিন আদৌ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়নি। অথচ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা ইজরায়েল কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে সাড়ে সাত দশক আগেই।

অসলো চুক্তি যখন সই হয় তখন পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। এখন সেই সংখ্যা ৭ লক্ষাধিক। শান্তি চুক্তিতে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন পিএলও পার্টি। কিন্তু ২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন করে আসছে হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। আবার গাজার সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল এবং মিশর, যাতে হামাসের কাছে কোন অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে।

অসলো চুক্তির ধারাবাহিকতায় পরে ১৯৯৫, ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে বিভিন্ন জায়গায় উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিডে তখনকার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইহুদ বারাক ও ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উদ্যোগে। তবে সে বৈঠক ব্যর্থ হলে শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের নতুন সংগ্রাম, যা দ্বিতীয় ইন্তেফাদা হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘দ্বিতীয় ইন্তিফাদা’ বলা হয়।

২০০৩ সালে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাষ্ট্রসংঘের প্রচেষ্টায় একটি রোডম্যাপ তৈরি হয়, যার লক্ষ্য ছিল ২০০৫ সালের মধ্যে চূড়ান্ত আলোচনার পর্যায়ে আসা। কিন্তু তাও কার্যকর হয়নি। ২০০৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ম্যারিল্যান্ডে এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। যাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মাহমুদ আব্বাস অংশ নেন। এক ডজনের বেশি আরব দেশ তাতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যেই গাজায় নির্বাচনে জিতে যাওয়া হামাসের তাতে কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না।

এরপর ২০১০ সালে ওয়াশিংটনে আবারো শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কয়েক সপ্তাহে কিছু অগ্রগতির পর তাতেও অচলাবস্থা তৈরি হয়। ২০১৪ সালের এপ্রিলে দু-পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনা শেষ পর্যায়ে এসে ভেস্তে যায়। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট গাজোযারি করে জেরুসালেমকে একতরফা ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে দিলে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়।

২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা’ প্রকাশ করেন, তাতে জেরুসালেমকে ইসরায়েলের অবিভক্ত রাজধানী হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন। আমেরিকা তার দূতাবাসও তেলআবিভ থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে নিয়ে যায়, যা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে ফিলিস্তিনিদের।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এবং পশ্চিম তীরের বসতি এলাকায় ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব দেন ট্রাম্প। কিন্তু ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ট্রাম্পের ওই পরিকল্পনাকে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

ফিলিস্তিন একসময় ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ফিলিস্তিনে যারা থাকতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব, সেই সঙ্গে অল্প কিছু ইহুদী, যারা ছিল একেবারেই সংখ্যালঘু।

কিন্তু যখন ইহুদীদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিল ব্রিটেন, তখন থেকেই মুসলিম ও ইহুদীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করল। ইহুদীরা এই অঞ্চলকে তাদের আদি পুরুষদের নিবাস বলে দাবি করে। আরবরাও দাবি করে, এই ভূমি তাদের এবং ইহুদীদের জন্য সেখানে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার তারা বিরোধিতা করে।

১৯২০ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ইউরোপে ইহুদীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসী রাষ্ট্রপ্রধান হিটলার এর দ্বারা ভয়ংকর ইহুদী নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে এরা নতুন এক মাতৃভূমি তৈরির স্বপ্ন দেখছিল।

ফিলিস্তিনে তখন ইহুদী আর আরবদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হলো, একই সঙ্গে সহিংসতা বাড়ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও। ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে দুটি পৃথক ইহুদী এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হল। জেরুজালেম থাকবে একটি আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে। ইহুদী নেতারা এই ওই প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু আরব নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাষ্ট্রসংঘের এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।

ব্রিটিশরা এই সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছাড়ে। ইহুদী নেতারা এরপর ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। আর এটা হয় মূলত মার্কিন ও ব্রিটিশ মদদেই।

Stay Connected

Advt.

%d bloggers like this: