মীযান ডেস্ক: ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে কার্যত মিরাকল ঘটিয়েছেন নীতীশ কুমার। মধ্যিখানে সামান্য সময় বাদে প্রায় ১৮ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরও নটআউট। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল মাত্র ৪৫ জন বিধায়ক নিয়ে ২৪৩ সদস্যের বিহার বিধানসভা ও রাজ্য সরকারে যাবতীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা। আর এই সময়কালে লালু প্রসাদ যাদবের দলকে সঙ্গে নিয়ে বিহার থেকে একরকম বিজেপিকে মুছে দিতে পেরেছেন নীতীশ। এক্ষেত্রে লালু যাদব ও তাঁর দলও কেবলমাত্র গেরুয়া শিবিরকে রুখতে নীতীশের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। সুতরাং এর কৃতিত্ব লালু ও তার পুত্র তেজস্বীরও; নীতিশের একার নয়। নীতীশ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, আর তেজস্বী হয়েছেন উপমুখ্যমন্ত্রী। যদিও নীতিশের জেডিইউ দলের বিধায়ক সংখ্যা ৪৫, আর লালুর দল আরজেডি-র এমএলএ ৮০জন। তবুও নীতীশকে মুখ্যমন্ত্রী পদে মেনে নিয়েছে আরজেডি।
অবশ্য ১৮ বছরের রাজ্যপাটে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেও জাদুকর কুড়মি নেতা নীতীশ সরকার চালিয়েছেন অবলীলায়। বারেবারে নীতীশের এই ভোলবদল এবং তার জেরে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যা নিয়ে মাঝে মধ্যে ধন্দ, সংশয় ও রহস্য দানা বাঁধে। অনেকটা পেন্ডুলামের মতো। এবার ২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি তাঁর দল ভাঙার জন্য মহারাষ্ট্রের মতো ‘অপারেশন লোটাস’-এর ষড়যন্ত্র করতেই, জাতপাতের ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগিয়ে তুলে নরেন্দ্র মোদিকে পাল্টা আঘাত করেছেন নীতীশ। শুক্রবার আরও একধাপ এগিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত জাতপাতভিত্তিক সমীক্ষা ও জনগণনা প্রক্রিয়ায় বাধাদান ও রিপোর্ট প্রকাশে নিষেধাজ্ঞার আবেদন খারিজ করে মোক্ষম ধাক্কা দিয়েছে গেরুয়া শিবিরকে। রাজ্যে রাজ্যে হিন্দুত্বের ছাতা থেকে বেরিয়ে পণ্ডিত, ঠাকুর, বানিয়া, কুড়মি, দলিত, ওবিসি, মুসলিম, আদিবাসী, উপজাতিরা নিজেদের আইডেন্টিটি পলিটিক্স শুরু করলে বা সংখ্যানুপাতে বিভিন্ন অধিকারের পক্ষে দাবি জানালে বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।
হিন্দি বলয়ে বিশেষত উত্তরপ্রদেশে আবার যাদব, দলিত এবং ওবিসিদের পৃথক উত্থান শুরু হবে। সেক্ষেত্রে ছ’মাস বাদে যোগীরাজ্যে ৮০-র মধ্যে ৭০টা লোকসভা আসন জেতা স্বপ্নই থেকে যাবে বিজেপির। মুখ থুবড়ে পড়বে ৫৬ ইঞ্চির তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খোয়াইশ!
জাতপাতের সমীক্ষা বলছে, বিহারে কুড়মি জনসংখ্যা মাত্র ২ শতাংশ। তবে নীতিশের মূল শক্তি রাজ্যের ৮৭ শতাংশ পিছিয়েপড়া বা অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। তারওপর রয়েছে ৬৩ শতাংশ ওবিসি। বলা বাহুল্য, কিছুটা কোণঠাসা, আবার কিছুটা ক্ষমতা হারানোর দুশ্চিন্তা থেকেই ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নিঃশব্দে মণ্ডল রাজনীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু হল নীতীশ কুমারের হাত ধরে। যার সূচনা করেছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। এদিকে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের সেমি ফাইনালের আগে জাতপাতভিত্তিক জনগণনা গেরুয়া শিবিবের কাছে নিঃসন্দেহে বড় ধাক্কা। এই ধাক্কাকে সুনামিতে পরিণত করতে কংগ্রেস এবং বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট রাজ্যে রাজ্যে এরকম জনগণনা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। যা বিজেপি তথা এনডিএকে আরও কোণঠাসা করছে। তাই সর্বশক্তি দিয়ে বিজেপি বাধ সাধলেও জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ২ অক্টোবরকেই এই জনগণনা রিপোর্ট প্রকাশের জন্য বেছে নেন নীতীশ-লালুরা। বিহারীবাবুদের এই কৌশল শেষ পর্যন্ত সফল হলে মোদিজির পাকা ঘুঁটি নিশ্চিতভাবেই কেঁচে যাবে। বিজেপির হিন্দু-মুসলিম বাটোয়ারা নীতির বদলে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককেই টুকরো করলে আরএসএস-এর সাজানো বাগান ছারখার হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়—অনেকটা ২০০৪ সালে বাজপেয়ির ভরাডুবির মতোই! তখন মোদির সাধের মহিলা সংরক্ষণ আইন অশ্বডিম্ব প্রসব করবে। সর্বোপরি বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে দুরমুশ বা বুলডোজ করে ছাড়বে। তাই এই সেন্সাস নিয়ে মোদি-শাহদের এত গাত্রদাহ হচ্ছে।
